নিজের ও পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর স্বপ্ন নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ভোলার যুবক মুরাদ। কিন্তু এক প্রতারক দালালের খপ্পরে পড়েন তিনি। ওই দালাল তার কষ্টার্জিত টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়। ফলে মুরাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। তবে মুরাদ এতে ভেঙে পড়েননি। বরং সব কাজ নিজেই করে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রয়োজনীয়তা দূর করে দেন। সৌভাগ্যবশত মুরাদের জন্য সমাধান হয়ে এসেছিল মোবাইল অ্যাপ ‘আমি প্রবাসী’। দেশ ছাড়ার আগে যেসব কাজ করতে হয়, সেগুলো এই অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনেই সম্পন্ন করতে পেরেছেন তিনি। পাশাপাশি অ্যাপটির সুবাদে ঘন ঘন ঢাকা যাওয়ার প্রক্রিয়াটি আরও সহজ হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটি মুরাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাকে প্রায়ই ভোলা থেকে ঢাকায় যেতে হতো। নিজের অতীত অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুরাদ বলেন, ‘আগে আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে সাহায্য চেয়েছি, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রক্রিয়া চলাকালে জালিয়াতির কারণে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা খুইয়েছি। ‘তবে কদিন আগে “আমি প্রবাসী” অ্যাপের খোঁজ পাই। এর মাধ্যমে নিবন্ধন করার ফলে আমার কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে। অবশেষে আমার বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। খুব শিগগিরই আমি বিমানে উঠছি।’
আকাঙ্ক্ষা পূরণের সেতু
বছরের পর বছর ধরে বিদেশে অভিবাসনের চিত্র ভয়াবহ অপ্রীতিকর এবং জঘন্য রয়ে গেছে। তবে অমি প্রবাসী অ্যাপের সহায়তার কারণে বিভিন্ন কার্যালয়ে গিয়ে দালালদের পিছন পিছন ঘোরার কষ্ট এখন লাঘব হয়েছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-র (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহিদুল আলম বলেন, ‘এই অ্যাপের সাহায্যে অভিবাসীরা প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন। প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হলে সহজেই তাদের সার্টিফিকেট ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। সিস্টেমটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের প্রশিক্ষণের অবস্থা হালনাগাদ করবে।’
আমি প্রবাসী অ্যাপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পিডিও (প্রি-ডিপার্চার ওরিয়েন্টেশন), টিকাগ্রহণ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য যাচাই করে। এতে একদিকে যেমন সময় বাঁচে, তেমনি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাজই জবাবদিহির আওতায় আসে এবং ভোগান্তিমুক্ত হয়। আমি প্রবাসীর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও নামির আহমদ নুরী বলেন, ‘পুরো অভিবাসন প্রক্রিয়ায় এই অ্যাপ ব্যবহার করলে ভুল করা কিংবা প্রতারণার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ চাকরির বিস্তারিত তথ্য, বেতন ও বৃত্তান্ত বাংলাদেশি হাই কমিশন যাচাই করে।’
হাতের নাগালে সরকারি সেবা
আমি প্রবাসী প্ল্যাটফর্মের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি ব্যবহারকারীর দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দিতে পারে। জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করার জন্য অভিবাসীদের আর কাজ থেকে ছুটি নিতে হয় না, মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপরও নির্ভর করতে হয় না। বিএমইটিতে নিবন্ধন, প্রি-ডিপার্চার ওরিয়েন্টেশন, বিএমইটি ক্লিয়ারেন্সসহ আরও অনেক কাজ এখন স্মার্টফোনে মাত্র কয়েকটা ট্যাপ করে বা আমি প্রবাসী পোর্টালের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায়। আমি প্রবাসী ও বাংলা ট্র্যাক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক একরামুল হক বলেন, ‘আমি প্রবাসী দারুণ ফল এনে দিয়েছে। এর মাধ্যমে ২.৫ মিলিয়নেরও বেশি বিএমইটি নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া মাত্র দুই বছরে নিবন্ধন সংখ্যা বেড়েছে ৫০০ শতাংশ। অজস্র প্রবাসী কর্মীকে আকৃষ্ট করেছে এই প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশের শ্রমশক্তি এর সুফল পাচ্ছে।’
এই প্ল্যাটফর্মের সুবাদে সরকারও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। আমি প্রবাসীর মাধ্যমে সরকারি কার্যালয়ে না গিয়েও এমএফএসের মাধ্যমে (বিকাশ/নগদ) সহজেই বিভিন্ন সরকারি সেবার ফি পরিশোধ করা যায়। এর মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে ৮০ কোটি টাকার বেশি জমা হয়েছে।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ক্ষমতায়ন
আমি প্রবাসী শুধু কাজই সহজ করে না, সেইসঙ্গে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ক্ষমতায়নও করে। নামির বলেন, ‘আমাদের প্রথম পণ্য বিএমইটি ডেটা ব্যাংক এন্ট্রি সফল হয়েছিল। তাই আমরা একে আরও এগিয়ে নিয়ে যাই।’
কিউআর কোড স্ক্যানার ও বায়োমেট্রিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারের মতো হার্ডওয়্যারের সাহায্যে গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ অভিবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে আমি প্রবাসী। স্বচ্ছতার কারণে বৈধ চাকরি খোঁজা ও ভিসার তথ্য নিশ্চিত করে মানব পাচার বন্ধ করার ক্ষমতা আছে এই প্ল্যাটফর্মের। আমি প্রবাসীর অ্যাপটি স্বল্পশিক্ষিতসহ সবার জন্যই অভিবাসন প্রক্রিয়া সহজ করছে। ব্যবহারকারীর পাসপোর্ট থাকলে তারা অ্যাপের মাধ্যমে ‘জার্নি ম্যাপ’ দেখা, চাকরি খোঁজা, নিয়োগকারী এজেন্সিগুলোতে আবেদন এবং সব ধরনের সরকারি ধাপগুলোর কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন। আমি প্রবাসীতে অনলাইনেই বিএমইটি এয়ারপোর্ট ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়। এর ফলে ভুয়া নথিপত্রের প্রয়োজন হয় না। এতে সব অভিবাসনপ্রত্যাশীর জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাও উন্নত করা যায়। আমি প্রবাসী প্ল্যাটফর্মের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো নারী কর্মীদের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি। তারেক বলেন, ‘সমস্ত নথিপত্র এবং প্রশিক্ষণ যাচাই ও প্রত্যয়ন করে এই প্ল্যাটফর্ম। ফলে মিথ্যা নথিপত্র জমা দেওয়ার কোনো সুযোগ এখানে নেই। এতে নারীরা ক্ষতি ও শোষণের হাত থেকে রক্ষা পান।’
এখন পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি নারী অ্যাপটির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে নাম লিখিয়েছেন। অনেক সাধারণ মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই অ্যাপ। তেমনই একজন ঢাকার দোহারের তরুণী ফরিদা বেগম। ফরিদা বলেন, ‘অ্যাপটি আমাকে বিএমইটিতে নিবন্ধন করা থেকে শুরু করে প্রি-ডিপার্চার ওরিয়েন্টেশনে যোগ দিতে মেডিকেল পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতাল খুঁজে বের দেওয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে নির্দেশনা দিয়েছে। আমার মনে হয়েছে, আমি নিজেও এই জটিল কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারব।’
এই প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীরা তাদের আবেদন কোন অবস্থায় আছে, তা জানার জন্য নিয়োগকারী সংস্থা বা বিএমইটিকে মেসেজও পাঠাতে পারেন।
মূল অংশীদারত্ব ও অসুবিধা
আমি প্রবাসী উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেও, বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়েছে। নামির দাবি করেন, ‘বর্তমান ম্যানুয়াল সিস্টেম সিন্ডিকেটের স্বার্থান্বেষী মহল এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা কিছু সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ডিজিটাইজেশনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই বাধা সত্ত্বেও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিএমইটি, ব্র্যাক ও আইসিটি বিভাগের সঙ্গে অংশীদারত্বে প্ল্যাটফর্মটি এগিয়ে গেছে। ডিজিটাল ব্যবস্থায় পরিচালিত অভিবাসন ব্যবস্থা চালুর আশা জুগিয়েছে ‘
স্মার্ট বাংলাদেশের পথে
বিএমইটির সহায়তায় কিউআর কোড স্থাপন বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফিজিক্যাল স্মার্ট কার্ড প্রিন্টিংয়ের প্রয়োজনীয়তা দূর করেছে আমি প্রবাসী। এর ফলে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড সময়মতো ইস্যু করা হচ্ছে; দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর দরকার পড়ছে না; কমেছে জালিয়াতির ঝুঁকিও। এ প্ল্যাটফর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে অবদান রাখা। ব্যবহারকারী-বান্ধব ইন্টারফেস, সময়-সাশ্রয়ী ফিচার ও ব্যয়-সাশ্রয়ী সমাধান নিয়ে আমি প্রবাসীর লক্ষ্য অভিবাসন প্রক্রিয়ার ‘ওয়ান-স্টপ সলিউশন’ হয়ে ওঠা। আমি প্রবাসী রিক্রুটমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এ-আরএমএস) বাংলাদেশে দারুণ জনপ্রিয় নিয়োগ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম। ১ হাজারের বেশি এজেন্সি এটি ব্যবহার করে। এ প্ল্যাটফর্ম অভিবাসনপ্রত্যাশীদেরকে সবচেয়ে বড় ডেটাবেজে প্রবেশাধিকার দেয়, সেইসঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বাড়াতে ওপেন কমিউনিকেশন চ্যানেলে বাছাইযোগ্য ও ফিল্টারযোগ্য ডেটাবেজও সরবরাহ করে। ফলে প্রক্রিয়াকরণ খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনে আমি প্রবাসী, কারণ এর ফলে আর উৎকোচ দেওয়ার দরকার পড়ে না। আমি প্রবাসী ব্যবহারের ফলে ব্যয় ২০ শতাংশ কমে আসে বলে জানান এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
সাপোর্ট ও পেমেন্ট সিস্টেম
কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে তাকে সাহায্য করতে প্ল্যাটফর্মটিতে সপ্তাহে সাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা সহায়তা দেওয়ার জন্য হেল্প সাপোর্ট সিস্টেম আছে। কেউ চাইলে সহজেই তাদের হটলাইনে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আমি প্রবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। তারেক বলেন, পিডিও, বিএমইটি ও চাকরির সত্যতা যাচাই করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করে দিতে পারেন তারা। বিভিন্ন সরকারি সেবার জন্য সুবিধাজনক ও বিস্তৃত পেমেন্ট সিস্টেম রয়েছে আমি প্রবাসীতে। অ্যাপটি থেকে ব্যবহারকারীরা বিএমইটি নিবন্ধন ও ক্লিয়ারেন্স, প্রি-ডিপার্চার, ওয়েলফেয়ার বোর্ডের সদস্যপদ, বিমা ও স্মার্ট কার্ড ফির জন্য পেমেন্ট করতে পারেন। এছাড়া মোবাইল ওয়ালেট বা ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করেও পেমেন্ট করা যায়। প্রতিটি পেমেন্ট প্রক্রিয়া নিশ্চিত ও ঝামেলামুক্ত করে আমি প্রবাসীর সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
‘আমি প্রবাসী’র ইতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ প্ল্যাটফর্মের উদ্ভাবনী পদ্ধতি এবং অভিবাসী কর্মীদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সক্ষমতার বিষয়টি লক্ষ করেছে। প্ল্যাটফর্মটি এখন অন্যান্য দেশের জন্য মডেল হয়ে উঠেছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে প্রশংসাও কুড়াচ্ছে। প্ল্যাটফর্মটির লক্ষ্য বিশ্লেষণ ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে দক্ষ অভিবাসীদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া, এবং মানবপুঁজির আরও দক্ষ ও কার্যকর বরাদ্দ নিশ্চিত করা। নামির বলেন, ‘আমরা অনেকদূর এগিয়েছি, কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি। আমাদের লক্ষ্য হলো প্রত্যেক অভিবাসনপ্রত্যাশীর ক্ষমতায়ন করা। এছাড়া এমন একটি অভিবাসন প্রক্রিয়া গড়ে তোলা যা সবার জন্য নির্বিঘ্ন, ন্যায্য ও সাশ্রয়ী হবে।’
সূত্র : দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড