লাইফস্টাইল
খাঁটি মধু চিনবেন কীভাবে?
Deprecated: Function get_the_author_ID is deprecated since version 2.8.0! Use get_the_author_meta('ID') instead. in /home/bkotha24/public_html/wp-includes/functions.php on line 6114
অনলাইনে এখন অনেক রকম মধুর বিজ্ঞাপন হরহামেশা চোখে পড়ে। বিশেষ করে এখন সরিষা ফুলের মৌসুম চলছে, হলুদ সরিষা ক্ষেত থেকে মধু আহরণের ছবি দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছেন অনেকেই। মধু ব্যবসায়ী ও মধু নিয়ে কাজ করা অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে সরিষা ফুল থেকেই সবচেয়ে বেশি মধু উৎপাদন করা হয়। এমন কী সীমিত আকারে বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে সরিষা ফুলের মধু। এছাড়া ভিন্ন ভিন্ন ফুলের সময় ভিন্ন ভিন্ন মধু উৎপন্ন করা হয়ে থাকে। তবে আগ্রহের শীর্ষে বরাবরই সুন্দরবনের মধু।
মধুর প্রকারভেদ
মধু প্রধানত দুই প্রকার। প্রাকৃতিক আর চাষ করা মধু, যেটাকে চাষের মধু বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক মধুর একমাত্র উৎস সুন্দরবন। মৌয়ালরা সেটা সংগ্রহ করে ও তা সারা দেশে বাণিজ্যিকভাবে বিপণন হয়ে থাকে। এর বাইরে আমরা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে গ্রামে যে মৌমাছির চাক দেখি তা আসলে খুবই সামান্য মধুর যোগান দেয়। সুন্দরবনে অন্তত সাত রকম ফুলের মধু হয়ে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশে চাষ করা মধুর মধ্যে পাঁচ রকম ফুলের মধু বেশি দেখা যায়।
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধু
সুন্দরবনে ফুল ফুটতে শুরু করে মার্চ মাস থেকে। এ সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে মধু আহরণের জন্য সুন্দরবনে আসতে থাকে মৌমাছির ঝাঁক। আর মধু আহরণের জন্য মৌয়ালদের বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মধু ব্যবসায়ী আনতা নূর জানান, পহেলা এপ্রিল থেকে আমরা অনুমতি নিয়ে মধু কাটতে যাই, দুই মাস এই অনুমতি থাকে।সুন্দরবনে প্রথমেই আসে খলিশা মধু। খলিশা নামক এক প্রকার গাছের সাদা ফুল থেকে মৌমাছিরা এই মধু সংগ্রহ করে মৌচাকে জমা করে। যখন সুন্দরবনে খলিশা গাছে ফুল ফোটে তখন অন্য সব গাছে মুকুল থাকলেও ফোটে না। ভিন্ন স্বাদ ও একক ফুলের মধু হিসেবে এই মধুটির চাহিদা বেশি কিন্তু সে তুলনায় উৎপাদন কম।
সাতক্ষীরার আরেক মধু ব্যবসায়ী ও মধু আহরণকারী শামীম হোসেন জানান, খলিশা ফুলের মধু একটু সাদা রংয়ের হয়, মিষ্টিও বেশি। এখন আমরা প্রতি কেজি ১২০০ টাকা করে এটি বিক্রি করছি, খলিশা মধুর পর আসে গরান ফুলের মধু। এটি একটু লাল রংয়ের হয়ে থাকে। গরান মধু সবচেয়ে বেশি সময় ধরে থাকে ও বেশি পরিমাণে সংগ্রহ করা হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে পশুর, কেওড়া ও বাইন ফুলের মধু সংগ্রহ করেন মৌয়ালরা। জুন মাসের দিকে মৌসুম শেষ হয় গেওয়া ফুলের মধু দিয়ে। এছাড়া আরেকটি হয় মিশ্র মধু। যা মূলত বিভিন্ন ফুল থেকে সংগ্রহ করা মধু।
মধু সংগ্রহের পর তা রিফাইন করে সংরক্ষণ করেন ব্যবসায়ীরা এবং সারা বছর ধরেই সেটি বাজারে পাওয়া যায়। সর্বনিম্ন ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ ১২০০ টাকায় বিক্রি হয় এসব মধু। তবে এখন সুন্দরবন অঞ্চলেও মধুর চাষ হয়ে থাকে। মৌসুমের শুরুতে মৌমাছির বাক্স নিয়ে যায় চাষীরা, এরপর মৌসুম শেষে মধু সংগ্রহ করে ফেরে। এ সব মধুরই রঙ, স্বাদ ও গন্ধ ভেদে পার্থক্য থাকে। ঘনত্বও কম বেশি হতে পারে।
চাষের মধু
সরিষা ক্ষেতের পাশে এখন অনেক জায়গায় কাঠের বাক্স চোখে পড়ে। যেগুলোর মধ্যে মূলত মৌমাছি থাকে, তবে এগুলো পোষা মৌমাছি বলা যেতে পারে। যারা সারাদিন ফুলে গিয়ে মধু সংগ্রহ করে আবার বাক্সে ফেরত আসে। সুন্দরবনের মৌমাছি ও এসব মৌমাছির জাত আলাদা। বাংলাদেশে সাধারণত পাঁচটি ভিন্ন জাতের মৌমাছি দেখা যায়। এর মধ্যে চারটিই পোষ মানে। ব্যক্তিগতভাবে মধু নিয়ে একটা গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়েছেন ঢাকার আরিফুল ইসলাম। তার নিজের মৌ খামার আছে ও এ বিষয়ে একটা বইও লিখছেন তিনি।
আরিফুল ইসলাম বলেন, বুনো জাতের মৌমাছি পোষ মানে না। আমাদের দেশে ১৯৮০ সালের দিকে একটা ইউরোপিয়ান জাত আনা হয়। এই জাতটা আমরা বক্সে পালি এবং তাদের প্রশিক্ষিত করে মধু সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সরিষা ফুলের মধু। “কারণ এটা সহজলভ্য এবং খরচও কম। তবে এই মধুর ঘ্রাণ একটু তীব্র হয়, মুখে দিলেই সরিষা ফুলের ঘ্রাণ আসে, হালকা সাদাটে সোনালি রং হয় এই মধুর।
সাতক্ষীরার চাষের মধুর পাইকারি ব্যবসায়ী রুবেল আহম্মেদ বলেন, এই শীতে সরিষা ফুলের মধু খুব সহজেই জমে যায়। কারণ এটাতে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকে। এটা জমে ক্রিম হয়ে যায়, যেটাকে আমরা ক্রিম হানি বলে থাকি। সরিষা ফুলের মধু কেজিতে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।
সরিষার পর মৌমাছির বাক্সগুলো যায় ধনিয়া ক্ষেতে। সেখানে ধনিয়া ফুল থেকে সংগ্রহ করা হয় মধু। এরপর হয় কালোজিরা ফুলের মধু। এই মধু সংগ্রহের পরই কালো থাকে ও খেতে খেজুরের গুড়ের মতো স্বাদ পাওয়া যায়। চাষের মধুর মধ্যে চাহিদার শীর্ষে লিচু ফুলের মধু। দেশের উত্তরবঙ্গের লিচু বাগান থেকে এই মধু সংগৃহীত হয়ে থাকে। লিচুর মধুতে হালকা সাদাটে সবুজাভ ভাব থাকে। আর খেতে গেলে লিচুর গন্ধ তো লাগবেই, বলেন আরিফুল ইসলাম। বর্ষার সময়টায় সংগ্রহ করা হয় কুল বা বরই ফুলের মধু। এটির পরিমাণ অবশ্য অনেক কম।
মধু চেনার উপায়
নানা কারণেই উপকারী এই মধু নিয়ে ক্রেতাদের অভিযোগ আর সন্দেহ আছে অনেক। মধু খাঁটি নাকি ভেজাল? আবার যে মধুর কথা বলা হয়েছে আসলেই সেটা দিয়েছে তো, এমন নানা প্রশ্ন দেখা যায়।
মধু গবেষক আরিফুল ইসলাম বলেন, মধু চেনার উপায় হল তিনটা। স্বাদ, বর্ণ ও গন্ধ। মধু চেনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাই আসল। কোনটার কী স্বাদ এটা মনে রাখা জরুরি। সুন্দরবনের মধুতে একটা বুনো গন্ধ থাকে। একটা মধুর সাথে আরেকটা মধুর পার্থক্য নির্ভর করে দুটি বিষয়ের উপর। উদ্ভিদের ভিন্নতা আর মৌমাছির জাতভেদে মধুর পার্থক্য হয়ে থাকে।
বিক্রেতা রুবেল আহম্মেদ জানান, একেক ফুলের মধুর ঘ্রাণ একেকরকম। খেতে গেলে বরই, লিচু এগুলোর ঘ্রাণ চলে আসে। তবে সবাই একমত মধু চেনার সবচেয়ে ভালো উপায় হল ল্যাব টেস্ট। কিন্তু বাংলাদেশ সেই সুবিধা খুব একটা নেই। এছাড়া নানান প্রচলিত যে সব উপায়ে অনেকে মধুর গুণাগুণ বিচার করেন, সেটাতে আপত্তি আছে বিশেষজ্ঞদের।
আরিফুল ইসলাম বলেন, এই যে আগুন দেয়া, পানিতে দেয়া এগুলোর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, মধুতে প্রাকৃতিকভাবেই চিনি থাকে আর চিনি থাকলে তো পিঁপড়া খাবেই। আর আগুন ধরার বিষয়টি হল মৌমাছি প্রাকৃতিকভাবে চাকে মোম তৈরি করে, ফলে আগুন তো ধরবেই। ল্যাব টেস্ট ছাড়া তাই উপায় নেই।
আর রুবেল আহম্মেদ জানান, মধু জমে গেলে খাঁটি না এই ধারণাটা ভ্রান্ত। আর মধু পানিতে মেশে কি মেশে না এটা মধুর ঘনত্বের উপর নির্ভর করে। সুন্দরবনের মধু সাধারণত জমবে না, ফ্রিজে থাকলেও না – বরং ঘনত্ব বাড়বে। তবে বেশি দিন ফ্রিজে রাখলে মধুর গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। তাই মধু যতোটা সম্ভব টাটকা খাওয়াই ভালো। আর ৩-৪ মাস পর সব মধুই লাল বর্ণ ধারণ করে। খাঁটি মধু পরিশোধন ছাড়া রেখে দিলে উপরে অনেকটা ফেনার মতো একটা স্তর পরে, যা ভেজাল মধুতে হয় না।
মধুর উপকারিতা
বাংলাদেশ কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইটে মধুর গুণাগুণ সম্পর্কে বলা আছে, রোগ নিরাময়ের জন্য মধু কখনো এককভাবে, আবার কখনো ভেষজ দ্রব্যের সঙ্গে মিশিয়ে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় সফলতার সঙ্গে ব্যবহার হয়ে আসছে। চায়ের সঙ্গে মধু ও আদার রস মিশিয়ে খেলে সর্দি ও শ্লেষ্মা রেগের উপশম হয়। আবার তুলসী পাতার এক চা চামচ রস ও সমপরিমাণ মধু মিশিয়ে খেলে অল্প সময়ের মধ্যেই কাশি দূর হয়। আবার হালকা গরম জলসহ মধু মিশিয়ে গড়গড়া করলে গায়কদের গলার স্বর বৃদ্ধি পায়। অনেকের মতে, এটা টনিকের মতো কাজ করে। এছাড়া এক চা চামচ আদার রস এবং এক চা চামচ মধু একসঙ্গে মিশিয়ে সকালে ও সন্ধেবেলা খেলে সর্দি সেরে যায় ও খিদে বৃদ্ধি পায়। শিশুদের দৈহিক গড়ন, রুচি বৃদ্ধি, ওজন বৃদ্ধি ও পেট ভালো রাখার জন্য প্রত্যহ এক চা চামচ মধু গরম দুধ ও গরম পানির সঙ্গে নাশতা ও রাতের খাবারের সঙ্গে দেয়ার কথা এখানে বলা আছে। তবে হজমের গোলমাল, হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস প্রভৃতি রোগে আধা চা-চামচ এর বেশি মধু না খাওয়াই ভালো।