রাজনীতি

নির্বাচনে নারী প্রার্থী, কী বিবেচনায় রাখে ভোটার ও দলগুলো

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ১২:২৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৩, ২০২৪

রাজধানী ঢাকার কাছের একটি জেলা গাজীপুর। এ জেলার পাঁচটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই এবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম গাজীপুর-৩ শ্রীপুর আসন। প্রথমবারের মতো এ আসনে কোন নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। বর্তমান সংসদ সদস্যসহ মনোনয়নপ্রত্যাশী পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে একজন নারী প্রার্থী রুমানা আলীকে বেছে নিয়েছে দলটি। এই পাঁচজনের মধ্যে রুমানার বড় ভাই ও প্রার্থী ছিলো। রুমানা এর আগে দলটির সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী রহমত আলীর মেয়ে রুমানা।

জাতীয় নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের সরাসরি মনোনয়নের সংখ্যা বরাবরই কম হলেও আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন এবার অতীতের তুলনায় বেড়েছে। যদিও পুরুষের তুলনায় তাও মাত্র পাঁচ শতাংশ। এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনে এক হাজার ৮৯৫ জন প্রার্থী রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৯৪ জন নারী। এবার নির্বাচনে ২৭টি দল অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে ১৪ টি দল এবার ৬৮ জন নারীকে মনোনয়ন দিয়েছে। বাকি ২৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে এ সংখ্যা ছিলো ৬৮ জন। এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ২৪ জন নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে বরিশাল ৪ আসনের শাম্মী আহমেদের মনোনয়ন বাতিল করেছে আদালত। এর আগে ২০১৮ এর একাদশ নির্বাচনে ১৮ জন নারীকে মনোনয়ন দিয়েছিলো দলটি।

বৃহস্পতিবার গাজীপুরের শ্রীপুরে বরমী ইউনিয়নের গাড়ারন এলাকায় গিয়ে জনসভায় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় রুমানা আলীকে। নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের দ্বারা যেসব হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন এখানে এক জনসভায় তা তুলে ধরেন তিনি। তার কাছে প্রশ্ন ছিলো নারীদের মনোনয়ন কম দেয়া হয় কেনো? তিনি বলেন, অনেকেই এ জায়গাগুলো তৈরি করে নিতে পারে না। সুযোগটা তৈরি হয় নি। নারীকে কাজের প্রমাণ সব জায়গায় পুরুষের তুলনায় বেশি দিতে হয়। পুরুষরাই-তো আমাদের জন্য একেবারে চ্যালেঞ্জ। তারা কাজ করার সুযোগ দেয় না। কাজ করতে চাইলেও পাশে এসে দাঁড়ায় না।

দেশের জাতীয় নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের মনোনয়নের ক্ষেত্রে পারিবারিক রাজনীতির সংস্কৃতি বেশি প্রাধান্য পায় কিনা এ প্রশ্নে বলেন, এটা এ উপমহাদেশের ট্রেন্ড। আরবসহ বিভিন্ন দেশে এ প্রাকটিস রয়েছে। পারিবারিক কারণেই আমাকে নমিনেশন দেয়া হয়েছে , এমন নয়। গত পাঁচ বছর কাজের মাধ্যমে আমার নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে।

তবে, বাবার রাজনীতির কারণে সুবিধাভোগী হয়েছেন এ কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, আব্বার তৈরি করা মাঠ পেয়েছি। তার কর্মীদের পেয়েছি। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। আমার জন্য বাবার মাঠের কর্মীরাই কাজ করছে। পারিবারিক বেনিফিট পাই আমি। এটা সত্যি।

তৃণমূল রাজনীতি করে নারীরা মনোনয়ন পায় কি? এমন প্রশ্নে বলেন, মতিয়া চৌধুরীর মতো অনেকেই আছেন। এ সংখ্যা খুব কম কি? সংখ্যা আছে। অনেকেই মনোনয়ন পেয়েছেন, নারী নেতৃত্বের জায়গাটা প্রস্তুত করে নিতে হয়। সবকিছুতেই নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়। সংসদের অনেক ভাষা আছে, সেগুলো জানতে হয়। আমাদের সরকার নারীবান্ধব সরকার। নিশ্চয়ই পলিসি চেঞ্জ হবে।

ভোটারদের তথ্য অনুযায়ী, এ আসনে সাত প্রার্থীর মধ্যে মূলত দুই প্রার্থীর ভোটের লড়াই হবে। মনোনয়ন পাওয়া রুমানা আলী ও মনোনয়ন না পাওয়া আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে অংশ নেবেন তিনি।

বৃহস্পতিবার শ্রীপুর পৌরসভার লোহাগাছ এলাকায় এক জনসভায় কথা হয় ইকবাল হোসেনের সাথে। কি বিবেচনায় তার দল এই আসনে মনোনয়ন দিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে ইকবাল হোসেব বলেন, দলীয় নেত্রী কি বিবেচনায় মনোনয়ন দিয়েছে সেটি তার বিষয়। কোন ক্রাইটেরিয়ায় মনোনয়ন দিয়েছে নেত্রী এটা জানার অধিকার আমার নেই। জিজ্ঞেস করতেও পারবো না। এটাও হতে পারে জনপ্রিয়তার দিক থেকে আমি অনেক বেশি। তাই আমি স্বতন্ত্র করলে একটা অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হলো। এটা একটা স্পেকুলেশন। নিঃসন্দেহে ওনি রাজনৈতিক পরিবারের। তার বাবা পাঁচবারের সংসদ সদস্য ছিলো এ আসনে। এটা তো সত্যি।

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তৃণমূল রাজনীতি থেকে উঠে আসা নারী নেতৃত্ব হাতেগোণা। বেশির ভাগ সময়ই দেখা গেছে সংরক্ষিত আসন থেকে বা পারিবারিক ঐতিহ্য বিবেচনায় নিয়েই মনোনয়ন দেয় দলগুলো। বিশেষ করে ভোটে জয় পরাজয়ের হিসাব, পারিবারিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশের নির্বাচনে নারী প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়। প্রার্থী তবে, ভোটাররা নারী -পুরুষ দেখবে না দাবি করে ইকবাল বলেন, “নারীরা সাধারণত ভোটের কর্মসূচিতে অংশ নেয় না কিন্তু কাজ করেছেন বলেই তারা সক্রিয় তার জন্য। কারণ পাঁচ বছর করেছি আমি।

এই আসনের ভোটাররা বলছিলেন, প্রার্থী নারী নাকি পুরুষ, সেটা নয়, তারা দেখতে চান কে তাদের জন্য উপকারী হবেন। শ্রীপুরের বাসিন্দা একজন নারী ভোটার বলছিলেন, যে যোগ্য ব্যক্তি তাকেই ভোট দিবো। নারী পুরুষ আমার কাছে বিষয় না। আরেকজন ভোটার বলছেন, মার্কা দেখছি না, আমরা দেখছি চরিত্র। যাকে বিপদে আপদে পাশে পাবো, তাকেই ভোট দিবো।’

গাজীপুরের ভাষা শহীদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে লেখালেখিও করছেন। ভোটে নারী মনোনয়ন কম পাওয়ার কারণ হিসেবে বলছেন, ভোটে জয় পরাজয়ের হিসাব দেখে মনোনয়ন দেয় রাজনৈতিক দলগুলো। শহরের ভোটার আর গ্রামের ভোটারের মানসিকতায় পার্থক্য আছে। শহরের ভোটারদের নারীর প্রতি মানসিকতায় একটু পরিবর্তন হলেও গ্রামের ভোটারের নারীর প্রতি মানসিকতা এখনো চেঞ্জ হয় নি। রাজনৈতিক দলগুলো মাঠের ভোটের হিসাব করে, নারী ভোট পাবে কিনা নির্বাচিত হবে কিনা এসব বিবেচনায় রাখেন তারা।

এ আসনের অন্যান্য প্রার্থীরা হলেন: স্বতন্ত্র এ কে এম সাখাওয়াত হোসেন, জাতীয় পার্টির সাইফুল ইসলাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের মো. আব্দুর রহমান। এছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের মো. জহিরুল হক মণ্ডল বাচ্চু, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মো. জয়নাল আবেদীন।