আন্তর্জাতিক

‘পশ্চিমা দেশে চীনের শিক্ষার্থীরা যেভাবে ভার্চুয়াল অপহরণের শিকার হচ্ছে’

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ৫:৫২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৫, ২০২৪

ওয়াশিংটনে থাকা চীনের দূতাবাস যুক্তরাষ্ট্রের বসবাসরত তাদের নাগরিক বিশেষ করে শিক্ষার্থীদেরকে ভার্চুয়াল কিডন্যাপিং বা ভার্চুয়াল অপহরণে’র বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর ১৭ বছর বয়সী কাই ঝুয়াং নামে একজন চীনা তরুণকে উটাহ্ অঙ্গরাজ্যের বনাঞ্চল থেকে উদ্ধার করার পর এক বিবৃতিতে এই পরামর্শ দেয় চীনা দূতাবাস। ওই তরুণকে একটি অস্থায়ী ক্যাম্পসাইট থেকে উদ্ধার করা হয়। ওই তরুণের বাবা-মা তার স্কুলের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, তাদের কাছে একটি ছবি পাঠিয়ে মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে। ওই ছবিতে মনে হচ্ছে যে তাদের ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে।

চীনের স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, সাইবার-অপহরণের শিকার ভুক্তভোগীদেরকে নিজেদের একাকী করে ফেলতে বাধ্য করা হয়। এছাড়া তাদেরকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে- এমন সব ছবি তুলতেও বাধ্য করা হয়। যদিও সেখানে অপহরণকারীরা সশরীরে থাকে না। তবে তাদের উপর ফেসটাইম ও স্কাইপে ব্যবহার করে নজর রাখা হয়। ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের সদস্য, দুই পক্ষকেই বোঝানো হয় যে তারা নির্দেশ মোতাবেক কাজ না করলে অপর পক্ষের ক্ষতি করা হবে। এই প্রতারণার মাধ্যমে কাইয়ের পরিবারকে চীনের কয়েকটি ব্যাংক হিসাবে ৮০ হাজার মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে বাধ্য করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত বিভাগ এফবিআইর তথ্য অনুযায়ী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অন্তত দুই দশক ধরে ভার্চুয়াল কিডন্যাপিং বা ভার্চুয়াল অপহরণের সাথে পরিচিত। এটা বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি হচ্ছে একটি অবৈধ উপায় যার মাধ্যমে প্রিয়জনকে উদ্ধারে একটি মুক্তিপণ দিতে ভুক্তভোগীদের বাধ্য করা হয়। স্বজনদের বোঝানো হয় যে মুক্তিপণ না দিলে সহিংসতা বা মৃত্যুর মুখে পড়তে পারে অপহরণের শিকার ব্যক্তি। চিরাচরিত অপহরণ ঘটনার মতো, ভার্চুয়াল অপহরণকারীরা প্রকৃতপক্ষে কাউকে অপহরণ করে না। এর পরিবর্তে প্রকৃত ঘটনা সামনে আসার আগেই প্রতারণা এবং হুমকির মাধ্যমে তারা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক একটি মুক্তিপণ আদায় করে নেয়।

চীনা শিক্ষার্থীদের কোথায় টার্গেট করা হচ্ছে?
পুলিশ বাহিনীর মতে, পশ্চিমা দেশগুলোতে থাকা চীনের বিদেশি শিক্ষার্থীদেরকে টার্গেট করছে সাইবার অপহরণকারীরা। গত ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের সাউথ ইয়র্কশায়ার পুলিশের প্রতারণা বিরোধী সমন্বয়ক দল বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা জারি করে। বিশেষ করে যেসব শিক্ষার্থীরা ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের শেফিল্ডে যাচ্ছিলো তাদেরকে সতর্ক করা হয়।

এই সতর্ক বার্তায় বলা হয়, এই প্রতারণার জন্য মূলত যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়নরত চীনা শিক্ষার্থীদেরকে টার্গেট করা হচ্ছে।এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা একজন প্রতারকের কাছ থেকে একটি ফোনকল পায়। যে নিজেকে চীনের দূতাবাস, অভিবাসন ও শুল্ক বিভাগ বা চীনের পুলিশ বা রয়াল মেইলের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয়। তারা একটি আন্তর্জাতিক অপরাধের বিষয়ে তদন্ত করছে এবং এটি নিশ্চিত হতে তারা চীনের একটি ব্যাংক হিসাবে বড় অঙ্কের অর্থ স্থানান্তর করতে বলে।

সাউথ ইয়র্কশায়ার পুলিশ বলছে, অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা ভুক্তভোগীদের হুমকি-ধামকি দিয়ে নির্দেশ মানতে বাধ্য করে। আরো বলা হয়, অপরাধীরা এই ঘটনাগুলো কাউকে বলতেও নিষেধ করে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের (এনএসডাব্লিউ) পুলিশ সতর্ক করে বলে যে, ভার্চুয়াল অপহরণ ক্রমাগত আরো জটিল রূপ লাভ করছে। এনএসডাব্লিউ পুলিশের ডিটেকটিভ সুপারিন্টেনডেন্ট জোসেফ ডুয়েইহি বলেন, এই প্রতারণা কার্যক্রম শুরু হয় চীনের মূল ভূখণ্ডে।প্রতারকরা নানা কৌশলে ভুক্তভোগীদেরকে চীনা কর্তৃপক্ষের একজন সদস্য হিসেবে অভিনয় করতে বাধ্য করে এবং এরপর আরেকজন নতুন ভুক্তভোগীর কাছে যেতে রাজি করায়।

এক সংবাদ সম্মেলনে মি ডুয়েইহি বলেন, এই প্রতারণার আওতায় প্রতারকরা ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে এবং বিদেশে ভ্রমণ করতেও বাধ্য করে। যেটা আমরা আগে কখনো দেখিনি। এমন কী আমাদের কিছু ভুক্তভোগী থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াতেও গিয়েছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যেও ভ্রমণ করেছে।

অস্ট্রেলিয়া ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বা এবিসি নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশের বরাত দিয়ে বলেছে, শুধু অক্টোবরেই অন্তত তিনটি ঘটনা ঘটেছে যেখানে ২০-২৩ বছর বয়সীদের সাথে অপরাধী চক্র চীনা কর্তৃপক্ষ সেজে যোগাযোগ করেছে। ভুক্তভোগীদেরকে তিন লাখ ৩৮ হাজার ৮৮০ ডলার করে পরিশোধ করতে বলা হয়েছিল। তা না হলে তাদেরকে চীনে ফেরত পাঠানো হবে বলে হুমকি দেয়া হয়। তাদেরকে বলা হয়েছিল যে, তারা একটি অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত।

সিডনিতে একটি ঘটনায় ২০ বছর বয়সী একজন তরুণকে হাতকড়া পড়ানো হয়েছিল। তাকে একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে করে অ্যাডিলেইড ও ভিক্টোরিয়াতে গিয়ে সম্ভাব্য আরো ভুক্তভোগীদের কাছে সাংহাই পুলিশের তরফ থেকে কথিত দাপ্তরিক নথি পাঠাতে বাধ্য করা হয়েছিল। ওই তরুণের পরিবারকে এক লাখ ৩৫ হাজার ৭৩০ মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা সেটা না করে এনএসডাব্লিউ পুলিশকে খবর দেয়। ২০২০ সালে এ ধরণের অন্তত আটটি ঘটনা নিশ্চিত হওয়ার পর এনএসডাব্লিউ পুলিশ একটি সতর্কতা জারি করে।

সেখানে বলা হয়, এসব ‘ভার্চুয়াল কিডন্যাপিং বা অপহরণের’ ঘটনায় ১৩ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৮ মার্কিন ডলার মুক্তিপণ দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে আসলে এমন কোন অপহরণের ঘটনাই ঘটেনি। ২০২০ সালের এপ্রিলে সিডনির শহরতলিতে একটি ঘটনা ঘটে। সে সময় রাইড পুলিশকে জানানো হয়েছিলো যে, এক চীনা নারী শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা মনে করে যে তাকে অপহরণ করা হয়েছে।

এ ঘটনায় মুক্তিপণ হিসেবে দুই লাখ তিন হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। অপহরণকারী চীনের পুলিশ কর্মকর্তা সেজে ফোন করে এই মুক্তিপণ দাবি করেছিল। এ ঘটনায় তদন্তের পর ওই নারীকে একদিন পর তার বাড়ি থেকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়। ২০২৩ সালের অগাস্টে জাপান টাইমস এক প্রতিবেদনে বলে, একই ধরণের ঘটনায় জাপানে কিছু চীনা শিক্ষার্থীকে প্রতারকরা ব্ল্যাকমেইল করেছে।

একটি ঘটনায় একজন নারী চীনা শিক্ষার্থীর বাবা-মা জানান, তারা চীনের একটি অ্যাকাউন্টে ৪২ হাজার ৩০০ ডলার পরিশোধ করেছে। এর আগে তাদের মেয়ের একটি ছবি তাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। ছবি দেখে মনে হচ্ছিলো যে, তাদের মেয়েকে মারধর করা হয়েছে। পরে জানা যায়, ওই শিক্ষার্থীকে এক ব্যক্তি ফোন করে হুমকি দিয়েছিল। ওই ব্যক্তি নিজেকে চীনের সরকারি নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল।

ওই ব্যক্তি ওই শিক্ষার্থীকে বলেছিলো যে, তার নামে একটি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তাই গ্রেফতারি এড়াতে যে অর্থ দরকার তা আদায় করতে তার বাবা-মায়ের কাছে একটি অপহরণের ঘটনা সাজানো উচিত। পুলিশ চীনের বিদেশি শিক্ষার্থীদের তাদের কাছে আসা ফোনকলের বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে। একই সাথে যে কোনও দাপ্তরিক আদেশ স্থানীয় দূতাবাসে যাচাই করতে বলা হয়েছে এবং যদি তারা প্রতারণার শিকার হয়েছে বলে মনে করে তাহলে পুলিশকে জানানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে।


সূত্র : বিবিসি বাংলা