আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়সীমা বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ১৭টি দল জানিয়েছে তারা এবারের এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে না। এসব দলের নেতারা বলেছেন, নির্বাচনের আগে সংসদ বিলুপ্ত না করা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে তারা এবারের এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া থেকে বিরত থেকেছেন।
নির্বাচন বর্জনকারী এসব দলের মধ্যে বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল রয়েছে যারা আগেই নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। তবে ১৭টি দল থেকে দলীয়ভাবে প্রার্থী না করা হলেও এসব দলের নেতারা কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন কি-না তেমন কোন তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। এর আগে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বুধবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে ত্রিশটির মতো নিবন্ধিত দল এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এছাড়া ২৬টি দল নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলো।
নির্বাচন বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষণ সংস্থা জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ-জানিপপের চেয়ারম্যান প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলছেন, বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তমূলক ও অংশগ্রহণমূলক যে নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আশা করছিলো সেটি শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে কারণ নিবন্ধিত সব দল নির্বাচনে আসেনি। এছাড়া যে চারটি বড় দল অধিকাংশ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে সেখান থেকে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি থাকলেও বিএনপি ও নিবন্ধন হারানো জামায়াত নেই। ফলে এটি আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নেই।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ ৩৯টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিলো। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বর্জন করেছিলো এবং সেবার মাত্র বারটি দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলো।
যেসব নিবন্ধিত দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না এমন দলগুলো হলো- নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনের থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশ, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা এনডিএম, বাংলাদেশের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বিজেপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (হারিকেন), গণফোরাম এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপ (গাভী)।
শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল -বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলছেন, নির্বাচনের পরিবেশ না থাকায় এ নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে তারা বিরত আছেন।
জাসদ (ইনু) ভেঙ্গে এ দলটি গঠিত হয়েছিলো। জাসদ (ইনু) অবশ্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের আছে এবং এবারের নির্বাচনে অংশও নিচ্ছে। দলীয় নেতা হাসানুল হক ইনুর কুষ্টিয়া-২ আসনে আওয়ামী লীগ কোন দলীয় প্রার্থী দেয়নি।
ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মোঃ রেহান আফজাল বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনার সময় তারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বর্তমান সংসদের বিলুপ্তি ও সেনাবাহিনী মোতায়েনের শর্ত দিয়েছিলেন। তারা আমাদের দাবি মানেনি। সে কারণে আমরা মনে করি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশই নেই। এজন্যই আমরা নির্বাচনে যাইনি।
ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা এনডিএমও এই একই কারণে অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ না থাকায় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না বলে জানিয়েছেন দলটির মিডিয়া বিভাগের দায়িত্বে থাকা আব্দুল্লাহ আল মামুন।
আর বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক বলছেন, তারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে একতরফা নির্বাচনের অংশ হতে চাননি। “আমরা এ ধরণের নির্বাচনে অংশ নিতে চাইনা যেখানে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।
যেসব দল নির্বাচনে আসেনি তারা দেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী -ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করে বলে মনে করে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, দেশের ভোটাররা দুই ভাগে বিভক্ত। এক দিকে আওয়ামী লীগ আর অন্য দিকে আওয়ামী লীগ বিরোধীরা। এই বিরোধী অংশটিরই প্রতিনিধিত্ব করে বিএনপি, জামায়াতসহ তাদের সমমনা নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো। তারা নির্বাচনে না আসায় বিরোধী সমর্থকরা কতটা নির্বাচনে অংশ নিবেন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
ধর্মভিত্তিক দলগুলো কী করছে?
নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেয়া কিংবা না-নেয়া নিয়ে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। নির্বাচনী রাজনীতিতে সক্রিয় ইসলামী আন্দোলন নির্বাচন বর্জন করলেও একসময় বিএনপির সাথে জোটে থাকা ইসলামি ঐক্যজোট এবারের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে। আবার দীর্ঘদিন ধরে ভোটের রাজনীতিতে অংশ নেয়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও খেলাফত মজলিসের এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না।আবার ইসলামিক ফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নিলেও আরেকটি ধর্মভিত্তিক দল জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। এর আগে ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যে ইসলামী ঐক্যজোট ছিলো সেখানে এই দলটির অংশগ্রহণ ছিলো এবং দলের একজন নেতা মাওলানা শাহীনূর পাশা চৌধুরী এমপিও হয়েছিলেন। শাহীনূর পাশা চৌধুরী কয়েকদিন আগে আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। এরপর তাকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেয় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। এরপর তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ওদিকে মুসলিম লীগের দুই অংশই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল সভাপতি শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী জানিয়েছেন যে এবারের নির্বাচনে ৫০টির মতো আসনে তারা প্রার্থী দিয়েছেন।
যারা অংশ নিচ্ছে তারা যা বলছে
২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বর্জন করলে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে আলোচনায় এসেছিলো বিএনএফ। সেবার দলের চেয়ারম্যান ঢাকা থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। দলটি এবারের নির্বাচনেও অংশ নিতে অর্ধশত আসনে প্রার্থী দিয়েছে। যদিও এবার ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে আলোচনা হয়েছে তৃণমূল বিএনপি ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম। এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য ২৩০টি আসনে নিজেদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে তৃণমূল বিএনপি।
বুধবার সন্ধ্যায় দলটির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার প্রার্থীদের যে নাম ঘোষণা করেছিলেন সেখানে বিভিন্ন দলের সাবেক পাঁচজন সংসদ সদস্যের নাম থাকলেও তার মধ্যে মৌলভীবাজার-২ আসনের এম এম শাহীন শেষ মূহুর্তে এই দলের ব্যানারে নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়েছেন।
এর বাইরে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান শেখ ছালাউদ্দিন জানিয়েছেন যে তার দল ২৩৭ আসনে আর বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টির দপ্তর সম্পাদক ইব্রাহিম মিয়া জানিয়েছেন তারা ১২৫ টি আসনে প্রার্থী দিয়েছেন।
নিবন্ধিত আরেকটি দল সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের প্রধান আবু লায়েস মুন্না জানিয়েছেন তারাও এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এবং দুশোর বেশী আসনে তারা প্রার্থী দিয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশ কংগ্রেসের সভাপতি কাজী রেজাউল হোসেন জানিয়েছেন যে তারা দুশোর বেশি আসনে প্রার্থী দিয়েছেন।
নিবন্ধিত দলগুলোর তালিকা
নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দল মোট ৪৪টি। এগুলো হলো এলডিপি, জেপি, সাম্যবাদী দল, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, সিপিবি, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্প ধারা, জাতীয় পার্টি, জাসদ, জেএসডি, জাকের পার্টি, বাসদ, বিজেপি, তরিকত ফেডারেশন, খেলাফত আন্দোলন, মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, ন্যাপ (গাভী), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (কাঁঠাল), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিস, মুসলিম লীগ- বিএমএল, সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট, বিএনএফ, এনডিএম, বাংলাদেশ কংগ্রেস, তৃণমূল বিএনপি, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাসদ (মটরগাড়ি), জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম ও সুপ্রীম পার্টি-বিএসপি।