প্রযুক্তি

ইউটিউবে যেভাবে শিশুদের কাছে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ১১:২২ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩, ২০২৩

বিজ্ঞানসম্মত কনটেন্টের আড়ালে ইউটিউবে ভুল ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, ২০টিরও বেশি ভাষায় এরকম ভিডিও দেখতে পেয়েছে বিবিসি গ্লোবাল ডিসইনফরমেশন টিম। যেসব ইউটিউব চ্যানেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ভিডিও বানায়, সেসব ভিডিওতে বিজ্ঞানের ভুল তথ্য খুঁজে পেয়েছে বিবিসির। আর এসব ভিডিও আবার শিশুদের কাছে ‘শিক্ষামূলক কনটেন্ট’ হিসেবে সামনে আসছে। আমরা ২০টিরও বেশি ভাষায় ৫০টির উপর ইউটিউব চ্যানেল শনাক্ত করেছি, যেগুলো বলছে যে তারা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত বিষয়ক কনটেন্ট বানায়, কিন্তু এসবের আড়ালে আসলে তারা মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে এমন কিছু বিষয় যেগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে বলে দাবি করা হয় কিন্তু আসলে নেই। এছাড়া ভুল তথ্য এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বও রয়েছে। যেমন পিরামিড থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন, মানুষের দ্বারা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি অস্বীকার এবং এলিয়েনের অস্তিত্ব নিয়ে কনটেন্ট। বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, ইউটিউব বাচ্চাদের কাছে নানান শিক্ষামূলক ভিডিওর পাশাপাশি এসব ‘ভুল বিজ্ঞান’ রেকমেন্ড করে সামনে আনছে।

যতো ক্লিক ততো অর্থ
কাইল হিল একজন ইউটিউবার ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রশিক্ষক, যার অসংখ্য তরুণ অনুসারী আছে। তিনি গত কয়েক মাস আগে হঠাৎ লক্ষ্য করতে থাকেন এই সমস্ত ভুল বিজ্ঞানের ভিডিও তার ইউটিউব ফিডেও আসছে। তিনি জানান, তারা অনুসারীরাই যোগাযোগ করে জানায় যে এই ‘রেকমন্ডেড’ কনটেন্টগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও আসলে নানা ভুল তথ্যে ভরা। তারা একই বিষয়ে করা কোন মূল ভিডিওর অংশ চুরি করে এবং সেখানকার তথ্যের খানিক পরিবর্তন করে নিজেদের সাইটে তুলে দিচ্ছে। এসব ভিডিওতে আজগুবি সব দাবি করা হয়, সেই সাথে থাকে চাঞ্চল্যকর বর্ণনা, নজরকাড়া শিরোনাম এবং নাটকীয় ছবি ব্যবহার করে দর্শককে আকর্ষণ করা হয়। কারণ যত বেশি ভিডিওটি দেখা হবে, এই চ্যানেলটি বিজ্ঞাপন থেকে তত অর্থ উপার্জন করবে। একই সাথে ইউটিউবেরও লাভ; কারণ বিজ্ঞাপনের ৪৫ শতাংশ অর্থ তারা নিয়ে নেয়। যারা এসব ভিডিও বানায় তারা এগুলো ‘শিক্ষামূলক কনটেন্ট’ হিসেবে ট্যাগ করছে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই এগুলো বাচ্চাদের কাছে বেশি যাচ্ছে। আমি একজন বিজ্ঞানের লোক হিসেবে এটা খুবই ব্যক্তিগতভাবে নেই। কারণ এই চ্যানেলগুলো খুব অল্প পরিশ্রমে কীভাবে সর্বোচ্চ ভিউ পাওয়া যায় সেই ব্যাপারটা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। আমরা লক্ষ্য করলাম বিভিন্ন ভাষায় অসংখ্য চ্যানেল ইউটিউবে এই ধরনের ভিডিও তৈরি করছে, যার মধ্যে আছে আরবি, রাশিয়ান, স্প্যানিশ এবং থাই। এর মধ্যে অনেক চ্যানেলেরই মিলিয়নের উপর সাবস্ক্রাইবার। তাদের ভিডিওর ভিউও প্রায়ই মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। এসব কনটেন্ট ক্রিয়েটররা খুব দ্রুতই তাদের ভিডিও প্রকাশ করে, কেউ কেউ একইদিনে একাধিক ভিডিও পোস্ট করছে। এত দ্রুততার সাথে তাদের ভিডিও প্রকাশ দেখে আমরা সন্দেহ করি তারা কোন এআই টুল বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রোগ্রামের সাহায্য নিচ্ছে্। এই প্রোগ্রামগুলো চ্যাট জিপিটির মতোই, বললেই আপনাকে নতুন কনটেন্ট বানিয়ে দেয় (যেমন-একটা কালো বিড়াল মুকুট পড়ে আছে) এরজন্য ইন্টারনেট সার্চ করে ওরকম কিছু খুঁজতে হয় না। বিষয়টি নিশ্চিত হবার জন্য আমরা প্রতিটি চ্যানেল থেকে ভিডিও নেই। এরপর আমরা এআই শনাক্তকারী টুল ও আমাদের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা বিশ্লেষণ করাই এটা বুঝতে যে এখানকার ছবি, ধারা-বর্ণনা ও স্ক্রিপ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে নেয়া। বিশ্লেষণে দেখতে পাই যে বেশিরভাগ ভিডিওর স্ক্রিপ্ট ও ছবি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এবং সেগুলো ঐ বিষয়ে কোন সত্যিকারের বিজ্ঞান ভিডিও থেকে কেটে নেয়া বা কারচুপি করা। ফলাফল: এই কনটেন্টগুলো মনে হবে বস্তুনিষ্ঠ কিন্তু আসলে বেশিরভাগই অসত্য।

বাচ্চাদের কাছে পৌঁছানো
আমরা দেখতে চেয়েছিলাম যে এসব ভুল বিজ্ঞানের ভিডিও বাচ্চাদের কাছে ইউটিউব রেকমেন্ড বা সুপারিশ করে কি-না। সেজন্য আমরা ইউটিউবের প্রধান সাইটেই কিছু বাচ্চাদের অ্যাকাউন্ট খুলি। (আমরা যেসব বাচ্চাদের সাথে কথা বলেছি তারা সবাই জানায় তারা ইউটিউব কিডসের চেয়ে প্রধান ইউটিউবটাই ব্যবহার করে থাকে)। চারদিন ধরে বিজ্ঞানবিষয়ক কিছু শিক্ষামূলক ভিডিও দেখার পর আমাদের কাছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভিডিওগুলো সাজেশন হিসেবে আসতে থাকে। আর আমরা যখন এগুলোতে ক্লিক করি, তখন আরও এসব ভিডিও রেকমেন্ড হতে থাকে। এর কিছু কনটেন্ট আমরা ১০ থেকে ১২ বছর বয়সীদের মধ্যে দুটো আলাদা দল করে দেখাই, যার একটা দল যুক্তরাজ্যে আরেকটা থাইল্যান্ডে। আমরা দেখতে চেয়েছি বাচ্চারা এসব ভিডিও দেখে বিশ্বাস করে কি-না। একটা ভিডিও আকাশে দেখতে পাওয়া রহস্যময় বস্তু যেগুলোকে ইউএফও বলা হয় এবং এলিয়নের অস্তিত্ব নিয়ে। আর আরেকটি গিজার পিরামিড বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার হত এমন মিথ্যা দাবির উপর ভিত্তি করে।

তবে আমাদের দর্শকরা এসব বিশ্বাস করেছে, আমরা দেখতে মজা লেগেছে,” একটা মেয়ে বলছিল, “আগে আমি এলিয়েনের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না, কিন্তু এখন আমার মনে হয় তারা আসলে আছে। আরেকটা বাচ্চা ইলেকট্রিক পিরামিডের বিষয়টা ভীষণ উত্তেজিত, “আমি জানতাম না যে এত আগেও মানুষ আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারতো।” তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ বুঝতে পারে যে ভিডিওগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি: “আমার কাছে তো খুব হাস্যকর লেগেছে, তারা একটা মানুষের কন্ঠস্বরও ব্যবহার করেনি, আমার তো মনে হয় না এটা মানুষের গলা ছিল,” বলছিল একজন। এরপর আমরা যখন তাদের কাছে ব্যাখা করি যে এগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি এবং এসবের মধ্যে মিথ্যা তথ্য আছে তখন তারা খুবই অবাক হয়: “আমি তো আসলে এখন কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি ভেবেছিলাম এসব সত্যি,” একটা ছেলে বলছিল। আরেকজন বলে: “এগুলো যে ভুয়া এটা আপনি না জানালে তো আমি সবই বিশ্বাস করে নিতাম।”

শিশুরা সাধারণত ভুল তথ্য বিশ্বাস করে
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বাচ্চাদের নতুন ও জটিল জিনিস জানার যে আগ্রহ সেটা নিয়ে খেললে তারা সত্য-মিথ্যা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ভিকি ন্যাশ মনে করেন, “এই ভিডিওগুলো ভালো করে কারণ এগুলো ষড়যন্ত্রতত্ত্বনির্ভর। আমরা যে কোন জানা জিনিসের বিপরীতে যখন কিছু বলা হয় সেটাতে আগ্রহ বোধ করি, আর বাচ্চারা বড়দের চেয়ে এসব ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রভাবিত হয়।”

ক্লেয়ার সিলে যুক্তরাজ্যের একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক এবং তিনিও এ ব্যাপারে একমত। “বাচ্চারা সাধারণত চোখের সামনে যেটা আগে দেখে সেটাকেই চূড়ান্ত সত্য বলে ধরে নেয়। এরপর যখন তাদের খানিকটা বয়স হয় তখনই তারা কেবল এটা নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করে,” বলেন তিনি।

প্রফেসর ন্যাশ এসব ভিডিও থেকে প্ল্যাটফর্মগুলোর টাকা কামানো নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন: “আমার কাছে এই যে ভুল বিজ্ঞানের ভিডিওর বিজ্ঞাপন থেকে ইউটিউব ও গুগল অর্থ আয় করছে এই পুরো ব্যাপারটাই অনৈতিক মনে হয়।” আমরা বেশকিছু কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করি যারা এআই কনটেন্ট তৈরি করে। একজন জানায় তাদের কনটেন্ট শুধুমাত্র ‘বিনোদনের জন্য’ বানানো। বাচ্চাদের লক্ষ্য করে কিছু করার বিষয়টা তারা অস্বীকার করে এবং একই সাথে জানায় তাদের স্ক্রিপ্টের বেশিরভাগে অংশ তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য ছাড়াই করেছে।

ইউটিউব আমাদের জানায় তারা অনুর্ধ্ব ১৩ বছরের জন্য ইউটিউব কিডস ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকে, যেখানে কোন ভিডিও দেখানো যাবে আর কোনটি যাবে না সে ব্যাপারে কড়াকড়ি আছে। তারা বলছে যে নিজেদের প্ল্যাটফর্ম থেকে মিথ্যা তথ্য সরানোর ব্যাপারে তারা বদ্ধ পরিকর এবং পরিবারগুলোকে তারা ‘নিরাপদ ও উচ্চমাত্রার ভিডিও অভিজ্ঞতা’ দিতে চায়। আর তারা এসব ভিডিওর বিজ্ঞাপনের রেভিনিউ থেকে অর্থ আয় করে কি-না সে প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়নি।

ধরা কঠিন হয়ে পড়ছে
এআই টুলগুলো দিনদিন আরও উন্নত হচ্ছে, যা দিয়ে কনটেন্ট বানানোও আরও সহজ হচ্ছে এবং এগুলো শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। ক্লেয়ার সিলি এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি মনে করেন শিক্ষক ও বাবা-মাদের এই নতুন হুমকির ব্যাপারে প্রস্তুত হতে হবে। “আমাদের এখনো আসলে পরিষ্কার ধারণা নেই যে কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কনটেন্ট বাচ্চাদের বোঝাপড়ায় প্রভাব ফেলছে। শিক্ষক হিসেবে আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এগুলোর মুখোমুখি হবার।”