বাংলাদেশের ইতিহাসে একতরফা নির্বাচনের যেসব নজির রয়েছে তার মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্যতম। সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক বিএনপি এবং তাদের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী সে নির্বাচন বয়কটের প্রেক্ষাপটে অর্ধেকের বেশি আসনে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হয়নি। জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল। নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৪৬টি আসনে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়। আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক হিসেবে বর্ণনা করে হয়েছে। যদিও সেটি নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক আছে। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি মনে করে ‘আদালতের রায়কে ব্যবহার করে’ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। ক্ষমতাসীন দলের অধীনে অনুষ্ঠিত একতরফা সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। বিএনপি এবং তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য ২০১২ সাল থেকে আন্দোলন করছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাদের সিদ্ধান্তে অবিচল ছিল। বিরোধীদের দাবি উপেক্ষা করেই নির্বাচনের দিকে এগুতে থাকে ক্ষমতাসীনরা।
হাসিনা-খালেদা টেলিফোন আলাপ-
রাজনৈতিক উত্তেজনা যখন সংকটের দিকে মোড় নিচ্ছিল তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিফোন করে বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছেন। এটি হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৬শে অক্টোবর। তখন বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে হরতাল কর্মসূচী পালন করছিল। টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী নেত্রীকে গণভবনে নৈশভোজের দাওয়াত দেন। সে সময় হরতাল প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেও সংলাপের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন বিরোধী নেত্রী। শেখ হাসিনার তৎকালীন তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী তখন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী বিরোধী নেত্রীকে বলেন, তার বেঁধে দেওয়া দুদিনের সময়সীমার মধ্যেই তিনি আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছেন, সুতরাং হরতালের এখন তো প্রয়োজন নেই।
হরতাল প্রত্যাহারে প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার তৎকালীন প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান তখন বলেছেন, বিরোধী নেত্রী প্রধানমন্ত্রীকে বলেন এটা যেহেতু ১৮ দলের কর্মসূচী, সে কারণে শেষ মুহূর্তে জোটের নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নেই। খালেদা জিয়াকে উদ্ধৃত করে তার প্রেস সচিব বলেছিলেন, সংলাপ এবং আন্দোলন একসাথে চালিয়ে যেতে কোন সমস্যা নেই।
শেখ হাসিনার সোমবারের নৈশভোজের দাওয়াত প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, মঙ্গলবার পর্যন্ত হরতালের কর্মসূচীর সময় তিনি বেরুতে পারবেন না। কিন্তু তারপর যে কোন সময়, যে কোন জায়গায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে প্রস্তুত।
সন্ধ্যে সোয়া ছয়টার দিকে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেন এবং প্রায় ৪০ মিনিট ধরে এই দুই নেত্রীর মধ্যে কথা হয়। প্রথমেই শেখ হাসিনা জিজ্ঞেস করেন দুপুরে তার ফোন কেন ধরেননি খালেদা জিয়া। উত্তরে বিরোধী নেত্রী বলেন, তার লাল ফোন অনেক দিন ধরেই বিকল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা তার জানা ছিলনা। সেই টেলিফোন আলাপের একদিন পরেই প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রীর কথোপকথন ইন্টারনেটে ফাঁস হয়ে যায়। সেই আলাপে খালেদা জিয়াকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছিল।
পর্যবেক্ষকদের অনেকেই তখন ধারণা করেছিলেন যে, রাজনৈতিক সুবিধা নিতে সরকারের তরফ থেকে সে টেলিফোন আলাপ ফাঁস করা হয়েছিল।
রাজনৈতিক অস্থিরতা-
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার যখন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন দেশের পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। একদিকে মানবতা-বিরোধী অপরাধের দণ্ডিতদের ফাঁসি কার্যকর করা এবং অন্যদিকে বিরোধী দলের ডাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী। এর মধ্যেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল ৩রা ডিসেম্বর। ৩০০টি আসনে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল ১১শ’র মতো। নির্বাচনের ১০দিন আগে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল ১৫দিনের জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের উদ্দেশ্য ছিল ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছিল, ততই সহিংসতাও বাড়তে থাকে। নির্বাচনের আগে ৩৮টি জেলায় প্রায় দেড়শ’র মতো কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় ব্যালট পেপার ও নির্বাচন সরঞ্জাম পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে।
এরশাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব
নির্বাচন যত এগিয়ে আসতে থাকে, জাতীয় এবং দলটির নেতা জেনারেল এরশাদকে নিয়ে নাটকীয়তাও ততই বেড়ে যায়। কারণ, আওয়ামী লীগ যেভাবে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সেজন্য জাতীয় পার্টিকে তাদের পাশে প্রয়োজন ছিল। অন্যথায় নির্বাচন বানচালের আশংকা দেখা দেয়। নির্বাচনের একমাস আগে এরশাদ নির্বাচনের বর্জনের ঘোষণা দিয়ে তার বাসা ছেড়ে সংবাদমাধ্যমের আড়ালে চলে যান। কিন্তু ২৪ঘণ্টা পরেই তিনি আবারো নিজের বাসায় ফিরে আসেন এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং-এর সাথে বৈঠক করেন। সে বৈঠকের পরে মি. এরশাদ আবারো দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য নির্দেশ দেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই মুহূর্তে আমি আমার দলের প্রার্থীদের ঘোষণা দিচ্ছি, তোমরা মনোনয়নপত্র তুলে নাও। তোমাদের জীবনকে বিপন্ন করো না। এরশাদ ধারণা করছিলেন যে, তার অবস্থানের কারণে তিনি হয়তো যে কোন সময় গ্রেফতার হতে পারেন। সুজাতা সিংয়ের সাথে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, গ্রেফতারের চেষ্টা হলে তিনি আত্মহত্যা করবেন।
নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টির মধ্যে যখন দোলাচল ছিল তখন এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল এরশাদ বলেছিলেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে তার দল নির্বাচন করবে না। তার এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এবং এটা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকা উচিত নয়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়লে সংকটের সমাধান হতে পারে। এর কয়েকদিন পরে জেনারেল এরশাদকে তার বারিধারার বাসা থেকে র্যাব নিয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে রাখে। র্যাবের তরফ থেকে বলা হয়েছিল যে ‘অসুস্থ বোধ’ করায় এরশাদকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তখন অভিযোগ উঠেছিল, নির্বাচনে অংশ নিতে এরশাদকে চাপ প্রয়োগের জন্য অসুস্থতার অজুহাতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে কার্যত ‘অবরুদ্ধ’ করা হয়।
এরশাদের একটি বিশেষ বার্তা উদ্ধৃত করে দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছিল, আমি অসুস্থ নই। গ্রেপ্তারের জন্য চিকিৎসার নামে আমাকে হাসপাতালে আটকে রাখা হয়েছে। তবে এমন প্রতিবেদনও তৎকালীন সংবাদমাধ্যমে এসেছিল যে জেনারেল এরশাদ মুখে যদিও বলেছেন তিনি নির্বাচনে নেই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে বসেই নির্বাচনে সক্রিয় হয়েছিলেন। এরশাদকে যখন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন রওশন এরশাদ। তখন জাতীয় পার্টি ঘোষণা করে যে তারা নির্বাচনে যাবে।
ভারতের অবস্থান
নির্বাচন নিয়ে যখন নানা অনিশ্চয়তা চলমান তখন ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে ঢাকায় আসেন ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। ঢাকায় এসে সুজাতা সিং বিভিন্ন পক্ষের সাথে বৈঠক করেন। এর মধ্যে বহুল আলোচিত বৈঠক ছিল জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের সাথে। সে বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নেবার জন্য ‘অনুরোধ করেছিলেন’ বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়। সুজাতা সিংকে উদ্ধৃত করে জেনারেল এরশাদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে না গেলে জামায়াত-শিবিরসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থান হবে৷ তারা ক্ষমতায় আসবে৷। বিভিন্ন পক্ষের সাথে বৈঠকের পরে ঢাকায় সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করার সময় তিনি বলেন, নির্বাচনে সর্বোচ্চ সংখ্যাক দলের অংশগ্রহণ বাঞ্ছনীয়।
সাংবাদিকদের সাথে সেই বৈঠকের সময় সুজাতা সিং-এর ভারতের অবস্থান পরিষ্কার করতে আর কোন রাখঢাক করেননি। তিনি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন এবং ভারত সেটাই চায়। ‘নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনভাবে অংশ নেবে এবং তা গ্রহণযোগ্য হবে। বাংলাদেশের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ সময়। পৃথিবীর যে কোন দেশের মতো বাংলাদেশেও জনগণ সুষ্ঠু ও অবাধে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে। এক্ষেত্রে সহিংসতা প্রহণযোগ্য নয়, বলেন সুজাতা সিং। সুজাতা সিং-এর সফরের পরে এবং নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের তৎকালীন হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণেই দলটির সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে ভারত যে কোন নির্বাচিত সরকারের সাথে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
তারানকোর চেষ্টা
চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান খুঁজতে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। ঢাকায় এসে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, নাগরিক সমাজ ও কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক করেন। নির্বাচন অংশগ্রহণমুলক করার জন্য তফসিল পেছানোর সুযোগ আছে কি না সেটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জানতে চান মি. তারানকো। নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠকে মি. তারানকো জানতে চান – নির্বাচনের তফসিল পিছিয়ে দেয়ার সুযোগ আছে কি না?
নির্বাচন কমিশন তারানকোকে জানিয়েছিল যে রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যে সমঝোতা হলে তফসিল পরিবর্তন করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তারানকোর উপস্থিতিতে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু উভয়পক্ষ তাদের অবস্থানে অনড় ছিল। সে বৈঠক নেয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আলোচনা মাত্র শুরু হয়েছে। অনেক খুঁটিনাটি বিষয় আগামীতে বিবেচনা করা হবে। তাই ফলাফল এখনই ধারণা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তারানকোর সফর কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সংকটের কোন সমাধান ছাড়াই ঢাকা ছাড়তে হয়েছিল জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার (জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল) ফার্নান্দেজ তারানকোকে।
বিএনপির ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’
পাঁচই জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য বিএনপির তরফ থেকে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ বা ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ নামক একটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। এজন্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৯শে ডিসেম্বর, অর্থাৎ নির্বাচনের আট দিন আগে। সারাদেশ থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঢাকার নয়াপল্টনে তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে আসার জন্য আহবান জানানো হয়। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের তরফ থেকে এই কর্মসূচী প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়া হয়। সরকার শুরু থেকেই কঠোর অবস্থান নেয় যাতে বিএনপি এ কর্মসূচি সফল করতে না পারে। বিএনপি নেতা-কর্মীরা ঢাকায় জড়ো হলে পুলিশ অ্যাকশনে যাবে বলে সতর্ক করে দেয়া হয়। কয়েকদিন আগে থেকে রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের অন্যান্য জেলার সড়ক, নৌ ও রেল যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। বিএনপি নেতা-কর্মীরা যাতে ঢাকায় আসতে না পারে সেজন্য পুলিশ এ পদক্ষেপ নিয়েছিল। সে সমাবেশে নেতৃত্ব দেবার কথা ছিল বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার। কিন্তু পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থানের পাশাপাশি ব্যাপক ধরপাকড়ের কারণে বিএনপির নেতা-কর্মীরা মাঠে নামতে পারেনি। এমনকি খালেদা জিয়াকে তার গুলশানের বাসা থেকে বের হতে দেয়নি পুলিশ। তাকে বাসার ফটকেই আটকে দেয়া হয়।
আন্তর্জাতিক অবস্থান
পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকার কিছু তৎপরতা ছিল। কিন্তু সেটি খুব বেশি দৃশ্যমান ছিলনা। ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার কিছু তৎপরতাও ছিল। নির্বাচনের দুই মাস আগে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা দিল্লি গিয়েছিলেন। তার সে সফরের উদ্দেশ্য ছিল – বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টি নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করা এবং ভারতের মনোভাব বোঝা। ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য ইকনোমিক টাইমস তখন এক প্রতিবেদনে লিখেছিল, মজিনাকে ভারতে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তিনি তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দিল্লি সফর করেন।
বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে মতভেদ ছিল। বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ভারত যে দৃষ্টিতে দেখছিল, আমেরিকা বিষয়টিকে সে দৃষ্টিতে দেখেনি। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ভারতের কলামিস্ট সীমা সিরোহি ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ওয়াশিংটন মনে করছে বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচনকে জনগণ অবৈধ মনে করবে এবং এটা আরো বেশি সহিংসতা তৈরি করবে। তবে এই সহিংসতার জন্য কারা দায়ী সেটি বলতে নারাজ আমেরিকা।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই-কমিশনারদের সাথে বৈঠক করেছেন। সেসব বৈঠকের মাধ্যমে তিনি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে ভারতের তৎকালীন হাইকমিশনার ও চীনের রাষ্ট্রদূতের সাথে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন তারানকো। অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী নির্বাচনের পরে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সাথে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। মুহিত ছিলেন তখন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে বৈঠকের পরে মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, “ মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, এরকম নির্বাচন যে হলো, তারপর আমাদের পরিকল্পনা কী? বিএনপির ঘোষিত ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ কর্মসূচীর সময় যখন সংঘাতের আশংকা দেখা দিয়েছিল তখন এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণভাবে মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে। এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফ থেকে বলা হয়েছিল যে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য জন্য পর্যবেক্ষক পাঠাবে না তারা।
সূত্র : বিবিসি বাংলা