আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ নামে নতুন এক শ্লোগান চালু করেছে। ক্ষমতাসীন দল এই শ্লোগান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে ২০১৪ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে। অনেকে মনে করেন,‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ শ্লোগানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ‘গণতন্ত্রকে’ পেছনে ঠেলে দিয়ে ‘উন্নয়নের’ বিষয়টিকে সামনে আনতে চাইছে। কিন্তু একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের বয়ানকে মানুষ কতটা গ্রহণ করেছে? অবকাঠামো উন্নয়নের দিক থেকে যেসব জায়গায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে চট্টগ্রাম অন্যতম। চট্টগ্রাম শহর এবং আশপাশে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অবকাঠামো হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ। দশ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করে করে এই টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর একপাশে পতেঙ্গা, অপর পাশে আনোয়ারা উপজেলা।
মানুষ কী বলছে?
টানেল থেকে বের হয়ে এক্সপ্রেসওয়ে। এই এক্সপ্রেসওয়ের পাশে ফসলের মাঠে বসে আছেন গিয়াস উদ্দিন। তাঁর বাড়ি বাঁশখালি উপজেলায়। পেশায় তিনি একজন সিকিউরিটি গার্ড। অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে কথা বলতে গেলেই তিনি বেশ আক্ষেপ করলেন। তার কথা হচ্ছে, উন্নয়ন হলেও তাদের জীবনে কোন পরিবর্তন আসেনি। দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতিতে টিকে থাকা দায় হয়ে গেছে তার জন্য। উন্নয়ন হইছে, আগে আমরা যেগুলা চোখে দেখি নাই সেগুলো দেখাইছে। কিন্তু দেখাইলে কী হবে? আমরা গরীব তো মরে যাচ্ছি। এগুলা দেখালে লাভ নাই তো। রাস্তা দিয়া আমরা ভাত খাব না তো। আমরা গরীব, আমাদেরকে সাহায্য করতে করতে হবে সরকারকে। এখন সরকার আমাদেরকে সাহায্য করতেছে না, রাস্তাঘাট করতেছে। রাস্তাঘাট দিয়ে ওরা চলুক, অসুবিধা নাই।
আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী মোঃ ইউনূস। তিনি একসময় মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। এখন কৃষি কাজের সাথে জড়িত। তিনি বলেন, এই রকম রোড (রাস্তা) আমরা বাংলাদেশের মাইধ্যে দেখি নাই। আল্লায় দিছে, আমাদের সরকারে এই উন্নয়নটা করছে। কিন্তু যেভাবে এক্সপ্রেসওয়ে করা হয়েছে তাতে রাস্তার একপাশে থেকে অপর পাশে যাবার সুযোগ নেই। এই এক্সপ্রেসওয়ের একপাশে ফসলি জমি এবং অন্যপাশে মানুষের বসতবাড়ি। ফসলের মাঠে কৃষি উপকরণ আনা-নেয়া করা এবং মাঠ থেকে ফসল তুলে বাড়িতে আনা তাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে গেছে। এই রাস্তা নির্মাণের সময় স্থানীয় কৃষক এবং মানুষের চলাচলের বিষয়টি চিন্তা করা হয়নি।
উন্নয়ন ও গণতন্ত্র
গত ১৫ বছরে চট্টগ্রামে নতুন ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল, নতুন-নতুন রাস্তা, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে যে সুবিধা হয়েছে সেটি সাধারণ মানুষ একেবারে অস্বীকার করছেন না। কিন্তু তারপরেও অনেকের মনে নানা প্রশ্ন রয়ে গেছে। এসব প্রশ্ন তৈরি হয়েছে নির্বাচনকে নিয়ে। আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ গ্রামের মোঃ হারুন বলেন, উন্নয়নেরও দরকার আছে, কিন্তু গণতন্ত্রেরও দরকার আছে। আমরা সেইটা মনে করি। গণতন্ত্র না থাকলে আমার যা ইচ্ছা আমি করবো, আপনার যা ইচ্ছা আপনি করবেন। গণতন্ত্র না থাকলে কথা বলার অধিকার থাকবে না।
তবে গ্রামাঞ্চলে ঘুরে যে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা গেল সেটি হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের সাথে খোলাখুলি কথা বলা কিংবা মতামত প্রকাশ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরণের ভয় কাজ করছে। এ বিষয়টি প্রকাশও করেছেন অনেকে। আহমেদ রহিম নামে এক গ্রামবাসী বলেন, আমরা এদিকে ওদিকে বললে আমাদের সমস্যা হইয়া যাবে। এটা বলছেন কেন? কী বলছেন? কোন পার্টি করেন?- এসব কথা জিজ্ঞাস করবে। আমরা পার্টি করি না, মেহনত করি খাইতেছি।
রাজনৈতিক বিতর্ক
অবকাঠামো উন্নয়নের নানা দিক নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় নানা প্রশ্নে তুলেছে। তাদের সবচেয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে – এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় দুর্নীতি হয়েছে। এই নির্বাচনে বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের রাজনৈতিক মিত্ররা ভোট অংশ নিচ্ছে না এবং তারা ভোট বর্জনের প্রচারণাও চালাচ্ছে। মানুষ যাতে ভোটকেন্দ্রে না যায় সেজন্য উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছে বিরোধী দলগুলো। এই প্রচারণায় তারা গণতন্ত্র, দুর্নীতি এবং সুশাসনের মতো বিষয়গুলো মানুষের সামনে আনছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি নেতারা বলছেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই উন্নয়ন টেকসই হতে পারে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত হতে পারে।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি শাহাদাত চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্র না থাকলে সুশাসন থাকবে না। সুশাসন না থাকলে দেশে দুর্নীতি থাকবে। যে পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে সেটা দিয়ে আমরা আরও ফ্লাইওভার করতে পারতাম, ব্রিজ করতে পারতাম, টানেল করতে পারতাম। দুর্নীতি না থাকলে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরকে সাজিয়ে তোলা সম্ভব হতো। চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। এই টাকা কোথায় গেলো?
চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসনে নির্বাচনে প্রচারণায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দাবি করছেন, আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায় থাকার কারণে এসব সম্ভব হয়েছে। এজন্য সরকারের ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন। সেজন্য সমালোচনাকে তারা খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ২০০৯ থেকে আজকে এই পর্যন্ত সরকারের ধারাবাহিকতায় দেশের মানুষের কি জীবনমানের উন্নয়ন হয়নি? দেখেন সমালোচনা পৃথিবীর আদিতে ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। সমালোচনাকে আমি ভালো চোখেই দেখি। তবে অনেকে আছে খামোখা সমালোচনা করে। এই যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের সুবিধা কি মানুষ পাচ্ছে না? ইকনমিক জোন হয়েছে মিরসরাইয়ে। এর সুবিধা কি মানুষ পাচ্ছে না? এসব উন্নয়নকে কেন্দ্র করে বিশাল কর্মযজ্ঞ হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। এর ফলে মানুষের যোগাযোগ যেমন বাড়ে তেমনি কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়। তবে শুধু অবকাঠামো তৈরি করার বিষয়টিকে বড় করে তুলে ধরার কোন যুক্তি দেখেননা পর্যবেক্ষকরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন-এর চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদক আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, এই সরকার বা তাদের অংশীজনদের স্তুতি বা আত্ম সন্তুষ্টির কোন শেষ নেই। মেগা প্রজেক্ট করেছেন। তাদেরই এক মন্ত্রী বলেছিলেন, মেগা প্রজেক্ট মানে মেগা চুরি। বাস্তবেও তাই। অবকাঠামো তৈরি করা উন্নয়নের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। মানবিক উন্নয়ন বলতে যেটা বোঝায় – শিক্ষার ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন একেবারে শূন্যের কোটায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে বলেই তাদের দল ১৫ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকতে পেরেছে। সেক্ষেত্রে বড় প্রকল্পগুলো মানুষের মনোযোগ কেড়েছে বলে তাদের ধারণা।