জাতীয়

নতুন আয়কর আইনে যেসব পরিবর্তন এসেছে 

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ৮:০৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৫, ২০২৩

গত জুন মাস থেকে নতুন আয়কর আইন চালু হয়েছে। দেশের করব্যবস্থা এত দিন ধরে ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ দিয়ে চলেছে। তবে বিভিন্ন সময়ে সেই আয়কর অধ্যাদেশের সংশোধন করা হয়েছে। নতুন আইনে অটোমেশনে জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নতুন আইনে রিটার্ন জমা, করপোরেট কর, কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন আয়কর আইন সম্পর্কে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য (আয়কর নীতি) সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, এই আইনে কিছু সমস্যা আছে। যেমন, কোনো করদাতার নথি নিরীক্ষা করতে হলে জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হবে। একজন করদাতার পেছনে বিভিন্ন কর অঞ্চলে একাধিক কর্মকর্তা ছুটবেন। এতে করদাতার হয়রানি আরও বাড়তে পারে। আবার সমস্যা দেখা দিলে সমাধান করছে কর বিভাগ। যেমন নতুন আইনে প্রথমে সঞ্চয়পত্রের উৎসে কর চূড়ান্ত দায় ছিল না। এটি এখন চূড়ান্ত দায় করা হয়েছে। তবে, সামগ্রিকভাবে আইনটি ভালো হয়েছে। বাংলায় সহজবোধ্যভাবে লেখা হয়েছে। আইনের বিভিন্ন দিক আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা অনুসারে প্রণীত হয়েছে। এবার দেখা যাক, কী ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে।

রিটার্ন জমায় যেসব পরিবর্তন
পুরোনো আইনের মতো নতুন আইনেও ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত করদাতারা রিটার্ন দিতে পারবেন। তবে এরই মধ্যে রিটার্ন জমার সময় দুই মাস বাড়ানো হয়েছে। নতুন আইনে কোনো করদাতার বার্ষিক আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার কম হলে তা করমুক্ত থাকবে। গত অর্থবছরে তা ছিল তিন লাখ টাকা। আগের আইনের মতো করমুক্ত আয়সীমা অতিক্রম করলেই ন্যূনতম কর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি চট্টগ্রাম সিটির করদাতাদের ৫ হাজার টাকা; অন্য সিটির করদাতারা ৪ হাজার টাকা এবং অন্য এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা কর দিতেই হবে। এত দিন রিটার্ন জমার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে সময় বৃদ্ধির আবেদন করা যেত। এ ক্ষেত্রে দুই থেকে চার মাস বাড়ানো যেত। কিন্তু নতুন আইনে সেই সুযোগ রাখা হয়নি। ৩০ নভেম্বর বা নির্ধারিত সময়ের পর রিটার্ন জমা দিলে জরিমানা যেমন দিতে হবে, তেমনই কোনো কর রেয়াতও মিলবে না। যেমন এত দিন যাতায়াত ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, ইন্টারনেট বিলসহ নানা ধরনের ভাতা পান চাকরিজীবীরা। এসব ভাতার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত ছিল। কিন্তু এখন ৩০ নভেম্বর বা নির্ধারিত সময়ের পর রিটার্ন দিতে গেলে এসব ভাতার অর্থ আর করমুক্ত থাকবে না। পুরোনো আইনের মতো নতুন আইনেও ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত করদাতারা রিটার্ন দিতে পারবেন। তবে এরই মধ্যে রিটার্ন জমার সময় দুই মাস বাড়ানো হয়েছে। নতুন আইনে কোনো করদাতার বার্ষিক আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার কম হলে তা করমুক্ত থাকবে। তবে ৩০ নভেম্বর বা কর দিবসের মধ্যে রিটার্ন দিলে এসব ভাতা করমুক্ত রাখার হিসাবটি সহজ করা হয়েছে। যেমন এসব ভাতার টাকার মধ্যে সাড়ে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত কিংবা বার্ষিক মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের মধ্যে যেটি কম, তা করমুক্ত থাকবে। নির্দিষ্ট সময়ের পর রিটার্ন দিলে বিনিয়োগজনিত কর রেয়াতও মিলবে না। সরকার নির্ধারিত খাত সঞ্চয়পত্র, পেনশন স্কিম, শেয়ারসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করলে বছর শেষে কর রেয়াত মেলে। পরে রিটার্ন দিলে এই করছাড় পাওয়া যাবে না। যাঁরা প্রথমবারের মতো রিটার্ন দেবেন, তাঁরা ৩০ নভেম্বরের পরিবর্তে ৩০ জুন পর্যন্ত রিটার্ন দিতে পারবেন। এটি এবারের আইনের নতুন সংযোজন।

এক পাতার ফরম
নতুন আইনে প্রথমবারের মতো ছোট করদাতাদের জন্য এক পাতার রিটার্ন ফরম বানানো হয়েছে। বার্ষিক করযোগ্য আয় ৫ লাখ টাকার কম হলেই এক পাতার আয়কর বিবরণী জমা দিলেই হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সম্পদের পরিমাণ ৪০ লাখ টাকার কম হতে হবে। ইতিমধ্যে করদাতার জন্য এক পাতার একটি ফরম প্রকাশ করেছে এনবিআর। এক পাতার ওই ফরমে সব মিলিয়ে ১৬ ধরনের তথ্য দিতে হবে। এগুলো হলো নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), সার্কেল, কর অঞ্চল, করবর্ষ, আবাসিক মর্যাদা, মোবাইল নম্বরসহ যোগাযোগের ঠিকানা, আয়ের উৎস, মোট পরিসম্পদ, মোট আয়, আরোপযোগ্য কর, কর রেয়াত, প্রদেয় কর, উৎসে কাটা করের পরিমাণ (যদি থাকে), এই রিটার্নের সঙ্গে প্রদত্ত কর, জীবনযাপন ব্যয়।

ভবিষ্য তহবিল, আনুতোষিক তহবিল
করপোরেট কর আদায় করতে কোম্পানির সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন আয়কর আইনে ট্রাস্ট ও তহবিলকে কোম্পানি হিসেবে বিবেচনায় এনে তাদের আয়ের ওপর সাড়ে ২৭ শতাংশ হারে করপোরেট কর বসানোর বিধান করা হয়েছে। আগের আইনে সমজাতীয় ধারায় শুধু ব্যক্তিসংঘ, আইনের দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তি এবং অন্যান্য করারোপযোগ্য সত্তার ওপর সাড়ে ২৭ শতাংশ করপোরেট কর বসত। এখন নতুন করে দুটি খাত যুক্ত করা হয়েছে। তহবিলকে করপোরেট করের আওতায় আনার ফলে ভবিষ্য তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড), আনুতোষিক তহবিলের (গ্র্যাচুইটি ফান্ড) আয়ের ওপর কর বেড়ে গেল। আগে এসব তহবিলের টাকা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করলে এর মুনাফার ওপর ৫ থেকে ১০ শতাংশ উৎসে কর বসত। এখন বছর শেষে সাড়ে ২৭ শতাংশ কর দিতে হবে। এর ফলে বেসরকারি চাকরিজীবীরা ভবিষ্য তহবিলের টাকা তুলতে গেলে আগের চেয়ে কম টাকা পাবেন। কিন্তু সরকারি চাকরিজীবীদের এসব তহবিলের আয়ের ক্ষেত্রে আগের মতো করমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়েছে। তবে তহবিলের ওপর এই কর কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর।

অটোমেশন
নতুন আইনের অন্যতম বড় পরিবর্তন হলো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের কর পরিশোধ। অটোমেটেড চালান বা এ চালানের মাধ্যমে কর পরিশোধ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে নতুন আইনে। পুরোনো আইনে পে অর্ডারসহ নানা উপায়ে কর পরিশোধ করা যেত। তবে প্রথমবার বলে করদাতাদের এ চালানে কিছুটা ছাড় দিয়েছে কর বিভাগ। কোনো করদাতা যদি রিটার্ন জমার সময় পে অর্ডার করে নিয়ে যান, এনবিআরের কর কর্মকর্তারা তা এ চালানে রূপান্তর করে নিচ্ছেন। ভবিষ্যতে এ চালানে কর পরিশোধ করতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় আইবাস সিস্টেমের মাধ্যমে এ চালানে কর পরিশোধ করা যায়। এনবিআরের জমা হিসেবে এই চালান তৈরি করতে হয়। মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কার্ড এবং ব্যাংকে নগদ টাকা প্রদান—চার ধরনের ব্যবস্থায় এ চালানে করের টাকা পরিশোধ করা যায়।

টিআইএন বাতিলের সুযোগ
নতুন আয়কর আইনে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাতিলের সুযোগ রাখা হয়েছে। পুরোনো আইনে টিআইএন বাতিল বা স্থগিত করা যেত না।নতুন আইন অনুসারে, ছয় শর্তে টিআইএন বাতিলের আবেদন করা যাবে। ১. রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা না থাকলে; ২. মৃত্যু, অবসায়ন, অবলুপ্তি বা অনুরূপ অন্য কোনো কারণে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়লে; ৩. স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ ত্যাগ করলে এবং বাংলাদেশে আয় করার কোনো কর্মকাণ্ড না করলে; ৪. ডুপ্লিকেট নিবন্ধন বা ভুল নিবন্ধন পেলে; ৫. আইনি মর্যাদা পরিবর্তন করলে; ৬. অন্য কোনো আইনানুগ কারণ প্রদর্শন করা হলে। করদাতারা নিজ নিজ কর অঞ্চলে টিআইএন বাতিলের আবেদন করতে পারবেন। করদাতার কাছ থেকে আবেদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর কর্মকর্তা চারটি বিষয় নিশ্চিত হয়ে টিআইএন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেবেন। ওই চারটি বিষয় হলো ওই করদাতার কাছে কোনো বকেয়া দায় নেই; করদাতার বিরুদ্ধে কোনো কর নির্ধারণ নিয়ে মামলা নিষ্পন্নাধীন নেই; যেকোনো ফোরামে আয়কর-সংক্রান্ত কোনো বিরোধ নিষ্পন্নাধীন নেই এবং করদাতা আবেদনপত্রে নিবন্ধন বাতিলের যে কারণ দেখিয়েছেন, এর সত্যতা আছে।

ক্ষমতায় যত পরিবর্তন
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) মহাপরিচালক পদমর্যাদার নিচের কর্মকর্তাদের কর ফাঁকি অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। নতুন আয়কর আইনের ২০৪ ধারায় বলা হয়েছে, তদন্তকারী আয়কর কর্তৃপক্ষ যেকোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কর ফাঁকির অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারবেন। একই আইনের ১৯৮ ধারায় তদন্তকারী আয়কর কর্তৃপক্ষ হয়ে কারা করদাতার বিষয়ে অনুসন্ধানকারী হবেন, তা বলা হয়েছে। সেখানে সিআইসির মহাপরিচালককে শুধু এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অন্য কোনো কর্মকর্তাকে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।নতুন আইনে কর অপরাধের জন্য ফৌজদারি মামলায় পাঁচ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আগে কোনো করদাতার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে এনবিআরের বোর্ড সভায় মামলার প্রস্তাব উপস্থাপন করে অনুমোদন নিতে হতো। এখন সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলের কর কমিশনারের অনুমোদন নিয়েই মামলা করা যাবে। তবে যেকোনো সময়ে অভিযুক্ত ওই করদাতার সঙ্গে আপস করতে পারবেন কর কমিশনার। তবে এ জন্য এনবিআরের অনুমোদন লাগবে।