আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে বেশ কিছু এলাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরোধ জোরালো হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা। শুক্রবার বরিশালে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী সভার মাঠে বরিশাল-৪ আসনের দুই পক্ষের বিরোধে সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। আরো কয়েকটি এলাকা থেকে এমন সংঘর্ষের খবরও পাওয়া গেছে গত কয়েকদিনে। এমনকি প্রার্থীরা পরস্পরকে হুমকি-পাল্টা হুমকি দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।ফলে কিছু এলাকায় কোন্দল ও সংঘাতময় একটি পরিস্থিতি হচ্ছে দলের অভ্যন্তরে। এখন প্রশ্ন উঠছে যে এর প্রতিক্রিয়া দলের কতটা দীর্ঘমেয়াদী হবে?
দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩০০ আসনের মধ্যে একশরও বেশি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে তীব্র কোন্দল ও বিভাজন তৈরি হয়েছে দলের মধ্যে। একাদশ জাতীয় সংসদে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হওয়া ১৮ জন সংসদ সদস্য এবার ভিন্ন প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করছেন আওয়ামী লীগেরই মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক তারানা বেগম বলছেন, দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হবার যে সুযোগ আওয়ামী লীগ দিয়েছে তাতে কিছু এলাকায় দলের মধ্যে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাবও হয়তো পড়বে। কিন্তু দলটি ক্ষমতায় গেলে হয়তো এ বিভাজন কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে না।
আরেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বলছেন, দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়াটাই প্রমাণ করে যে এই কোন্দল আগে থেকেই ছিল, যা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও বেড়েছে এবং নির্বাচনের পরেও এটি সহজে মিলিয়ে যাবে না বলেই ধারণা তার।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন বলছেন, পুরো বিষয়টিই নির্বাচন কেন্দ্রীক এবং নির্বাচনের পর এসবের রেশ থাকবে না। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর দেখবেন এসব আর নেই। তখন সবার ক্ষোভ, আশঙ্কা দূর হয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, এই নির্বাচনটি বর্জন করছে বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ আরো কিছু মিত্র রাজনৈতিক দল।
বিভেদ দীর্ঘস্থায়ী হবে?
নৌকা মার্কা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতার কারণে বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হয়েছে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি, যা সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসব ‘বিরোধ বা কোন্দল’ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে কতটা দীর্ঘমেয়াদী হবে? নাকি নির্বাচনের পর এসব ‘বিরোধ ও কোন্দল’ মিটে যাবে?
অধ্যাপক তারানা বেগম বলছেন, ক্ষমতা নিশ্চিত হয়ে গেলে এটি সামাল দেয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পক্ষ্যে খুব একটা কঠিন হবে না। তাই এগুলো দীর্ঘমেয়াদে বড় কোন প্রভাব ফেলবে না। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে হয়তো এমন পরিস্থিতিতে পড়তো না আওয়ামী লীগ। এখন যারা স্বতন্ত্র তারা জিতলেও তো বাহবাই পাবেন। তবে এ কারণে যে দ্বন্দ্ব কোন্দলে দলটি পড়ছে সেটি হয়তো পরে দলীয় নেতৃত্ব বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করবে। ক্ষমতায় থাকলে এটি কঠিন হবে না।
তবে জোবাইদা নাসরিন বলছেন, দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার মানেই হলো আগে থেকেই তারা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে আছেন। এখন নির্বাচনের পরেও এই কোন্দল বা একে কেন্দ্র করে যে সহিংসতাগুলো হচ্ছে তার রেশ সহজে কেটে যাবে বলে মনে হয়না। বরং এটি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল তৃনমূলে নিয়ে গেছে, যা ভবিষ্যতে আরো বাড়তে পারে।
তবে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন বলছেন, অতীতেও অনেক সময় বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছে অনেকে। পরে কিন্তু সেটা থাকেনি। তাই এটা স্থায়ী কোন বিষয় নয়। নির্বাচনে পর এসব ঠিক হয়ে যাবে।
কোন্দল কতটা দেখা যাচ্ছে
আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও দলটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার আত্মীয় এবং চীফ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরীর ভাই মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। তাদের ঘিরে সেখানে আগে থেকেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
মাদারীপুরের একটি আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষ ও বিরোধ ইতোমধ্যেই আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ঢাকার কাছেই শরিয়তপুরের একটি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সরকারের উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম। তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন খালেদ শওকত। এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে অতীতে একাধিকার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন খালেদ শওকতের বাবা প্রয়াত কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শওকত আলী। তিনি এক সময় জাতয় সংসদের ডেপুটি স্পিকারও ছিলেন। তাদের দুজনকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে দলীয় নেতা-কর্মীরা। গত কয়েকদিন পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলা-পাল্টা হামলার অভিযোগ করছেন। ঢাকার কাছে সাভারে সরকারের ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ওই আসনের সাবেক এমপি তালুকদার মোহাম্মদ তৌহিদ জং মুরাদ। ওই এলাকার আওয়ামী লীগ নেতারাও দুই প্রার্থীকে ঘিরে ভাগ হয়ে গেছেন এবং এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
চাঁদপুর জেলার প্রার্থীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার যে ভার্চুয়াল সভা করেছেন সেখানে জায়গা পাননি ওই জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তাদের বিরুদ্ধে দলীয় প্রার্থীদের অভিযোগ হলো তারা জেলার প্রতিটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য কাজ করছেন। পিরোজপুরে সরকারের মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন ওই এলাকার আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি এ কে এম আউয়াল। ইতোমধ্যেই দু গ্রুপের সংঘর্ষে সেখানে একজনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। মুন্সীগঞ্জের একটি আসনে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে গত ১৮ ডিসেম্বর বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ময়মনসিংহ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নিলুফার আনজুমের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন দলেরই জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ হাসান অনু। ফরিদপুর সদর আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শামীম হক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের সমর্থকদের মধ্যে কয়েক দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
এমপি হয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী যারা
জামালপুরে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান এবার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। আবার রাজশাহী-৪ আসনে তিনবারের এমপি এনামুল হক এবার কাঁচি প্রতীক নিয়ে নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করছেন। একাদশ সংসদের হুইপ ও চট্টগ্রাম-১১ আসন থেকে সামশুল হক চৌধুরী নৌকা প্রতীক নিয়ে আগে তিনবার বিজয়ী হলেও এবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী। সুনামগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের এমপি ও প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেন গুপ্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন দলের মনোনীত প্রার্থী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের বিরুদ্ধে। টাঙ্গাইল-৫ আসনের এমপি ছানোয়ার হোসেন এবার নির্বাচন করছেন ঈগল প্রতীক নিয়ে। একই ভাবে আরও যেসব সংসদ সদস্য দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন – নওগাঁ-৩ আসনের ছলিম উদ্দিন তরফদার, নওগাঁ-৪ আসনের ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক। বরিশাল-৪ আসনের পঙ্কজ দেবনাথ, কক্সবাজার-১ আসনের জাফর আলম, সুনামগঞ্জ-১ আসনের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, গাইবান্ধা-৪ আসনের মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, ঝিনাইদহ-৩ আসনের শফিকুল আজম খান, যশোর-৪ আসনের রণজিৎ কুমার, সাতক্ষীরা-২ আসনের মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, হবিগঞ্জ-২ আসনের আব্দুল মজিদ খান ও ময়মনসিংহ-৯ আসনের বর্তমান এমপি আনোয়ারুল আবেদীন খান। এসব এলাকায় বর্তমান এমপি ও নতুন মনোনীতদের ঘিরে দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব এখন চরমে উঠেছে। অনেক জায়গায় নতুন করে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের দলের পদধারী নেতা-কর্মীদের সমর্থন পেতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। আবার কোন কোন জায়গায় বর্তমান এমপির পরিবর্তে স্থানীয় নেতাদের সমর্থন পাচ্ছেন নতুন মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী।
সূত্র : বিবিসি বাংলা