বর্তমান সরকারের পতদ্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে গত তিন সপ্তাহ ধরেই অবরোধ ও হরতালের মত কর্মসূচী পালন করে চলেছে বিএনপি। যদিও একের পর এক কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও দলটির নেতা-কর্মীদের তেমন সক্রিয় উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। অনেকে বলছেন তারা আত্মগোপনে আছেন। এমন পরিস্থিতিতে নেতা-কর্মীদের মাঠে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে। কিন্তু এভাবে তাদের কতটা সক্রিয় করে তোলা যাবে, আন্দোলনের লক্ষ্য কতটা অর্জিত হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ কেন্দ্র করে সহিংসতা ও গ্রেফতারের পর থেকে একের পর এক হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। আন্দোলন সফল করার জন্য কীভাবে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের আরও সক্রিয় করে তোলা যায়, তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যায়, এ নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে বিএনপির শীর্ষ মহলে।
গ্রেফতার আতঙ্ক
বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের মধ্যে এখন গ্রেফতার আতঙ্ক রয়েছে। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে হওয়া সহিংসতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৬০০ মামলা দেয়া হয়েছে এবং দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘ক্র্যাকডাউন’ চালিয়েছে বলে অভিযোগ করছে বিএনপি। এর মধ্যেই বিএনপির মহাসচিব, জ্যেষ্ঠ নেতারাসহ একাধিক নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে। আন্দোলন দমন করার জন্য এসব গ্রেফতার ও সাজা দেয়া হচ্ছে বলে বিএনপি অভিযোগ করেছে।
যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যানবাহনে আগুন ও সহিংসতার মামলা বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের অভিযান ও দলটির অসংখ্য নেতা-কর্মী গ্রেফতার ও সাজা হওয়ার দলটির নেতা-কর্মীরা আতঙ্কে ভুগছেন। অনেকে বাড়িতে থাকছেন না। অনেক নেতাকে গত কয়েক সপ্তাহে প্রকাশ্য কোন কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি। এ কারণে চলমান অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচিতে রাজপথে খুব একটা সক্রিয় অবস্থানে দেখা যায়নি দলটির নেতা-কর্মীদের। এসব কর্মসূচিতে বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা মিছিল বা রাস্তায় টায়ার পুড়িয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করা ছাড়া তেমন কোনো কার্যক্রম দৃশ্যমান ছিল না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তাদের আন্দোলনের সাথে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণও দেখা যাচ্ছে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপি তাদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সংশ্লিষ্টতার কথা বললেও তাদের হরতাল বা অবরোধের মত কর্মসূচি মানুষের সমর্থন আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি ২০১৪-১৫ সালে এই ধরনের কর্মসূচি দিয়েও নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি, তাদের আন্দোলনও সফল হয়নি। এভাবে আন্দোলন করে লক্ষ্য কতটা অর্জন করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও বলছেন, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় নিশ্চিত করতে গ্রেফতারের ঝুঁকি নিয়েই নেতাকর্মীদের মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সামনের দিনগুলোতে হরতাল বা অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি নতুন ধরনের কর্মসূচি দেয়া হলে নেতাকর্মীরা আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখবে বলে ইঙ্গিত দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, গ্রেফতারের ঝুকি থাকলেও সরকারের পতন ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন তারা। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা বড় জমায়েত, সমাবেশের মত কার্যক্রমের মাধ্যমে আন্দোলন করলেও হরতাল, অবরোধের মত কর্মসূচি দেইনি। কিন্তু ২৮ তারিখের পর সরকার আমাদের মহাসচিব থেকে শুরু করে স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য, কেন্দ্রীয় নেতাদের আটক করে আমাদের বাধ্য করেছে অবরোধের মতো কর্মসূচিতে যাওয়ার জন্য।
বিএনপি ক্রমাগত অভিযোগ করে আসছে যে তাদের আন্দোলন দমন করার জন্যই পুলিশ এই ধরনের ধরপাকড় চালাচ্ছে। সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ তাই আত্মগোপনে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বলে দাবি করেছে দলটি। বিএনপির তৃণমূলের নেতাদের অনেকেই বলছেন, এখন পর্যন্ত নানা কৌশল অবলম্বন করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়িয়ে আন্দোলন চালিয়ে গেলেও ‘সময় আসলে প্রয়োজনে গণগ্রেফতার’ হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা রয়েছে তাদের।
কিছুদিন আগে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেছিলেন, গ্রেফতার বা মামলায় সাজা দিয়ে অনেক নেতাকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরানো হলেও তাতে দলের অভ্যন্তরে কোন সংকট তৈরি হবে না। কারণ তারা মনে করেন দলটিতে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা আছে এবং কেউ গ্রেফতার হলে বিকল্প নেতারাই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিবেন।
বিএনপি নেতাদের দাবি , বিএনপির এই চলমান অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচীর সাথে একাত্মতা জানিয়ে সাধারণ মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছেন। আন্দোলন আরো জোরদার হলে সাধারণ মানুষ বেরিয়ে এসে সরাসরি অংশ নেবেন বলে তারা মনে করেন। এর মাধ্যমেই তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জিত হবে বলে তাদের প্রত্যাশা। তবে বিএনপি নেতারা সাধারণ মানুষের সমর্থনের কথা বললেও বাস্তব চিত্র হল, অবরোধ কর্মসূচির শুরুর দিকে রাস্তাঘাটে যান চলাচল তুলনামূলক কম দেখা গেলেও শেষ কয়েকদিনের অবরোধে অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল পরিস্থিতি। সবশেষ ১৯ ও ২০শে নভেম্বরের হরতালে দূরপাল্লার কিছু যানবাহনও ঢাকা ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যাচ্ছে, আন্দোলনের পক্ষে মাঠে আরো জোরালো উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য তাদের তাগিদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অনেকে গ্রেফতার এড়িয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে চান।
ঢাকা মহানগরের একজন বিএনপি নেতা বলছেন, আমরা সবাই যদি গ্রেফতার হয়ে যাই, তাহলে মাঠে কর্মকাণ্ড কে চালাবে? দেশে তো আসলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার মতো পরিবেশ নেই। এই কারণে সতর্কতা হিসাবে আমরা কিছুটা আড়ালে থাকছি, কিন্তু আমাদের আন্দোলন অব্যাহত আছে। নির্বাচন যতো এগিয়ে আসবে, আন্দোলন ততো জোরদার হয়ে উঠবে। সেই জন্য তারা এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, চলমান আন্দোলনে তাদের ওপর মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় থাকার নির্দেশনা আসলেও সামনের দিনগুলোতে কর্মসূচি ঠিক কি হবে, সে বিষয়ে এখনও সুস্পষ্ট ধারণা নেই। ময়মনসিংহের একজন বিএনপি নেতা বলেন, মাঠ পর্যায়ে আন্দোলনে সক্রিয় থাকার পাশপাশি তাদের ওপর এমন নির্দেশনা রয়েছে যেন ‘সময়মত প্রয়োজনে গণগ্রেফতার’ হওয়ার প্রস্তুতি থাকতে হবে। তবে কোন সময় বা কী পরিস্থিতিতে সেরকম কৌশল বেছে নেবেন তারা, স্বাভাবিকভাবেই সে বিষয়ে মন্তব্য করেননি এই নেতা। ফলে গ্রেফতার অভিযানে তাদের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে না বলে এই নেতা দাবি করছেন। প্রয়োজন হলে তারা আরো কঠোর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার জন্যও প্রস্তুত রয়েছেন বলে তাদের দাবি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন নেতাকর্মীরা মাঠে সক্রিয় হলেও হরতাল বা অবরোধের মত পুরনো ধাঁচের কর্মসূচি দিয়ে দাবি আদায় করা বিএনপির জন্য কঠিন হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করছেন, নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের বিষয়টির চেয়ে আন্দোলনের নতুন কৌশল ও কর্মসূচি নির্ধারণ করা বিএনপির জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে এই মাত্রায় মামলা হয়নি বা তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। সেবারও কিন্তু বিএনপি আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে পারেনি। বিএনপি ঐ নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। সরকার তাদের চাপে ফেলে কোণঠাসা করতে চাইবেই, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের হরতাল বা অবরোধের মত সনাতন কর্মসূচি থেকে বের হয়ে এসে এমন কর্মসূচি দিতে হবে যাতে জনসমর্থন আছে।
বিএনপিসহ আরো কয়েকটি দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একদফা দাবিতে অনড় থাকলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সহ কয়েকটি দল এরই মধ্যে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বেশ কিছুদিন ধরে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছেন এবং বলছেন যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে তারা স্বাগত জানাবেন। তবে তফসিলের পর সংলাপের সম্ভাবনা তারা নাকচ করে দিয়েছেন। বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন তারা সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। সবশেষ আগামী ২২ ও ২৩শে নভেম্বর ষষ্ঠ দফায় ৪৮ ঘণ্টার জন্য অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। আঠাশে অক্টোবরের পর থেকে এখন পর্যন্ত দুদিন করে পাচ দফা অবরোধ ও দুই দফায় তিনদিন হরতাল পালন করেছে তারা।
সূত্র : বিবিসি বাংলা