বিশ্বজুড়ে ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালন করা হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দিনটি গত দুই বছর ধরে ভিন্নমাত্রা পেয়েছে।২০২১ সালের ১০ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও বাহিনীটির সাবেক কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দিনটিকে ঘিরে নানা রাজনৈতিক তৎপরতা দেখা যায়। এবারো ১০ই ডিসেম্বর ঢাকায় মানববন্ধন করতে চায় বিরোধী দল বিএনপি। যদিও পুলিশের দিক থেকে এখনো কোন অনুমতি মেলনি। এছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকই এখন কারাগারে কিংবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ্কই দিন সমাবেশ করতে চেয়েছিল ঢাকায় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইট এলাকায়। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের অনুমতি না মেলায় সে সমাবেশ করবে না আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কয়েকদিন আগে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বাইরে সমাবেশ না করলেও তারা ইনডোর অনুষ্ঠান করবেন।
নিষেধাজ্ঞা ‘টার্নিং পয়েন্ট’?
সরকার-বিরোধীরা মনে করেন, র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে ক্ষমতাসীনদের উপর আমেরিকার চাপ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সে কারণে ১০ই ডিসেম্বর রাজনীতিতে বাড়তি মাত্রা পেয়েছে।বিএনপির সাথে সম্পৃক্ত ও সরকার বিরোধীরা মনে করে, ২০২১ সালে র্যাবের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি রাজনীতির জন্য একটি ‘টার্নি পয়েন্ট’।
বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান বলেন, এটা নিশ্চয়ই নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিএনপি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুটা নিজেরা ফেস করেছে, নিজেরা নির্যাতিত হয়েছে। বিষয়টাকে যখন আন্তর্জাতিক মহল টেক-আপ করেছে তখন বিএনপি মনে করে যে তাদের এতদিনের সংগ্রামে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন একটি দিন পালন করে, সেই দিনটাকে বিএনপি আনন্দের দিন হিসেবে না দেখে বিএনপি এটাকে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলার দিন। সেজন্য এই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ।
এবারের মানবাধিকার দিবস এমন এক সময়ে পালিত হবে যখন বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে এবং এই নির্বাচন বয়কট করেছে বিএনপি। নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ধরার পাশাপাশি গণতন্ত্র ও নির্বাচনের ইস্যিুটিকে আন্তর্জাতিক মহলের সামনে আনতে চায় বিএনপি। “ভোটাধিকার একটি মানবাধিকার, গণতন্ত্র একটি মানবাধিকার,” বলেন মি. আসাদুজ্জামান।
২০২২ সালের ১০ই ডিসেম্বর বিরোধী দল বিএনপি নয়াপল্টনে তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে চেয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়িয়েছিল। বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা আমানউল্লাহ আমান তখন বলেছিলেন, “১০ই ডিসেম্বরের পরে খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে।” প্রথম দিকে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার জন্য অনড় অবস্থানে ছিল বিএনপি। অন্যদিকে সরকারপক্ষও শক্ত অবস্থান নিয়েছিল যাতে বিএনপি কোনভাবেই ১০ই ডিসেম্বর নয়াপল্টনে জড়ো হতে না পারে। সে সমাবেশের আগে পুলিশের সাথে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘাতে অন্তত একজন বিএনপি কর্মী নিহত হবার অভিযোগ উঠেছিল। এবার বিএনপির কর্মসূচির বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুনুর রশিদ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি কোন কর্মসূচী করতে চাইলে সেখানে যদি পরোয়ানাভূক্ত কোন আসামী অংশ তাহলে তাদের গ্রেফতার করা হবে।
অনুষ্ঠান করবে আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছর যাবত একটানা ক্ষমতায় থাকলেও ১০ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসটি ঘটা করে করে পালন করতে দেখা যায়নি। কিন্তু এবার তারা দিনটিতে সমাবেশ করতে চেয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর যে কোন ধরণের সভা-সমাবেশ করতে গেলে কমিশনের অনুমতি নেবার প্রয়োজন রয়েছে। আওয়ামী লীগ বলছে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি না মেলায় বাইরে সমাবেশের পরিকল্পনা থেকে তারা সরে এসেছে।
কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, একটা বড় সমাবেশ করবো এরকম একটা কর্মসূচী আমাদের ছিল। আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করেছি। সেই আবেদন তারা গ্রহণ করেননি। বাইরে সমাবেশের নামে শো-ডাউন হবে তারা এ আশংকা করছেন। যে কারণে ১০তারিখে মানবাধিকার দিবসের আনুষ্ঠানিকতা ভেতরেই পালন করবো।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, ১০ই ডিসেম্বরকে ঘিরে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঢাকায় জড়ো হবার চেষ্টা করতে পারে। সেজন্য তারাও সতর্ক রয়েছেন। সংবাদ সম্মেলন গত ৬ই ডিসেম্বর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মানবাধিকার দিবসকে ঘিরে বিএনপি নাশকতার পরিকল্পনা করছে। মানবাধিকার দিবসে সারাদেশে বিশৃঙ্খলা তৈরির প্ল্যান নিয়ে তারা এগুচ্ছে। এজন্য তারা জামাতকে একান্তই তাদের পাশে চায়।
নতুন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মানবাধিকার ইস্যুটিকে সরকার ও বিরোধী দল একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের পরে মানবাধিকার ইস্যুটা আমাদের রাজনীতিতে আলোচনার বিষয় হয়েছে। সত্যিকার অর্থে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান এবং মানবাধিকার রক্ষা করার যে প্রতিজ্ঞা – ঐ পর্যায়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এখনো আসেনি।
২০২১ সালের ১০ই ডিসেম্বর র্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি অনেকটা আকস্মিকভাবে এসেছিল। যদিও এর আগে থেকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘণের নানা অভিযোগ আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয়েছে। এরপর থেকে সরকার-বিরোধীরা বিভিন্ন সময় বলেছিল যে ‘আরো নিষেধাজ্ঞা’ আসতে যাচ্ছে। ২০২২ সালের ১০ই ডিসেম্বরের আগে অনেকে নতুন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করেছিলন। কিন্তু সেটি আর হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমস-এর অধ্যাপক সাঈদ মনে করেন, নতুন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিরোধী দলের মধ্যে একটা ‘রাজনৈতিক আকাঙ্খা’ তৈরি হয়েছে। কারণ অতীতের নিষেধাজ্ঞার কারণে সরকারের উপর একটা দৃশ্যমান চাপ তৈরি হয়েছিল। র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
‘নিষেধাজ্ঞা আসবে কেনো?’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, বড় রাজনৈতিক দলগুলো মানবাধিকারের প্রতি যতটা না শ্রদ্ধাশীল তার চেয়ে বেশি হচ্ছে তারা এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে পরষ্পরকে কোনঠাসা করতে চায়। বাংলাদেশে মানবাধিকার ইস্যুটা রাজনীতিকিকরণ হয়ে গেছে। সেজন্য ১০ই ডিসেম্বর দিনটি নিয়ে একটা বাড়তি প্রচারণা চালায় রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি সরকার বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে মানবাধিকার দিবসকে কাজে লাগাতে চায়। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা এর পাল্টা অবস্থান তৈরি করতে চায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘নিষেধাজ্ঞার’ বিষয়টি এখন সবচেয়ে আলোচিত। সে দৃষ্টিকোন থেকে ১০ই ডিসেম্বরের আগে নানা জল্পনা-কল্পনা তৈরি হয়।সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব কী করবে না করবে সে সম্পর্কে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই। তবে এটা ঠিক নিশ্চয়ই রাজনৈতিক মহলে নতুন কোন স্যাংশন আসতে পারে এই চাপ অবশ্যই অনুভূত হচ্ছে। এটা কতটা যৌক্তিক কতটা অযৌক্তিক সেটা নতুন কোন স্যাংশন না দেয়া পর্যন্ত তো বলা যাবে না।
সরকার-বিরোধীরা মনে করেন, মানবাধিকার কিংবা অন্য যে কোন ইস্যুতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আসলে সেটি তাদের জন্য বাড়তি রাজনৈতিক সুবিধা তৈরি করবে। সংবাদমাধ্যমেও এসব নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। শুক্রবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে প্রশ্ন করা হয় – নির্বাচনের আগে কোন নিষেধাজ্ঞা আসার সম্ভাবনা তারা দেখছেন কি না? এ প্রশ্নে মি. কাদের জবাব দেন, নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আমাদের কোন উদ্বেগ নেই। আমরা জানি, সংবিধান মেনে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এখানে নিষেধাজ্ঞা আসবে কেন?