বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চালু হল সর্বজনীন পেনশন স্কিম। সে স্কিমের আওতায় সরকারি চাকুরীজীবী ব্যতীত দেশের সকল নাগরিক পেনশন সুবিধার অন্তর্ভুক্ত হল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পর এটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ কারো বয়স ১৮ বছরের বেশি হলেই এখন অনলাইনে এটিতে নিবন্ধন করতে পারবেন।
উদ্বোধনের সময় শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের যারা সরকারি চাকুরিজীবী তারা তো পেনশন পান, কিন্তু যারা চাকরি করেন না তারা তো পান না, কাজেই এটা সরকারি চাকরিজীবিদের জন্য না। তার বাইরে যে জনগোষ্ঠী তাদের জন্য এই ব্যবস্থা। তবে সরকারের নতুন চালু করা এই সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন, আলোচনা। কারা, কীভাবে এতে যুক্ত হতে পারবেন, সুবিধা কী, কত টাকা দিতে হবে ইত্যাদি।
অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা বলেন, পেনশন স্কিম উদ্বোধনের পর থেকে অনেক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। প্রচুর লোক ওয়েবসাইটে ঢুকছে। উদ্বোধনের পরপরই একসাথে ১১০০/১২০০ লোক আমাদের প্ল্যাটফর্মে আসেন।
এই স্কিম কাদের জন্য?
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশের সর্বস্তরের জনগণকে সুবিধা দিতে এই পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। বিশেষ করে, গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা দেবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল শ্রেণী পেশার বাংলাদেশি নাগরিক এই স্কিমে অংশ নিতে পারবে। অর্থাৎ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের অংশ হতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র আবশ্যক। তবে ব্যতিক্রম আছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য, যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তারা চাইলে পাসপোর্ট দিয়েও নিবন্ধন করতে পারবেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে তার কপি জমা দিতে হবে। আবার বয়সের ক্ষেত্রেও বিশেষ বিবেচনা রাখা হয়েছে। যাদের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে তারাও সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে তিনি পেনশন পাবেন টানা ১০ বছর চাঁদা দিয়ে যাওয়ার পর। অর্থাৎ স্কিম অনুযায়ী ব্যক্তির বয়স ৬০ বছর হলেই তিনি সরকার থেকে পেনশন পেতে শুরু করবেন, তাকে আর চাঁদা দিতে হবে না। কিন্তু কেউ যদি ৫৫ বছর বয়সে এসে স্কিমে অংশ নেন তাহলে ৬৫ বয়স বয়স থেকে তিনি পেনশন পেতে শুরু করবেন। সরকার মোট ৬টি স্কিমের কথা ঘোষণা করেছে। তবে আপাতত চালু হয়েছে চারটি স্কিম। এগুলোর নাম দেয়া হয়েছে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা।
প্রবাস : এটি শুধু বিদেশে কর্মরত বা অবস্থানকারী বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য। এর মাসিক চাঁদার হার ধরা হয়েছে ৫ হাজার, সাড়ে ৭ হাজার ও ১০ হাজার টাকা করে। ব্যক্তি চাইলে এই চাঁদার সমপরিমাণ অর্থ তিনি যে দেশে আছেন সে দেশের মুদ্রায় দিতে পারবেন। আবার দেশে এসে দেশীয় মুদ্রাতেও দিতে পারবেন। এছাড়া প্রয়োজনে প্রবাস স্কিম পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকছে।
প্রগতি : এই স্কিম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য। এক্ষেত্রেও তিন ভাগে চাঁদার হার ভাগ করা হয়েছে। কেউ চাইলে মাসে ২ হাজার, ৩ হাজার বা ৫ হাজার টাকা করে দিয়ে এই স্কিমে অংশ নিতে পারবে। আবার প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের মালিকও প্রগতি স্কিমে অংশ গ্রহণ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে মোট চাঁদার অর্ধেক কর্মচারী এবং বাকি অর্ধেক প্রতিষ্ঠান বহন করবে।
সুরক্ষা : এই স্কিমটা স্বনির্ভর ব্যক্তির জন্য। অর্থাৎ কেউ কোথাও চাকরি করছেন না কিন্তু নিজে উপার্জন করতে পারেন, তারা সুরক্ষা স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। এর আওতায় পড়েন ফ্রিল্যান্সার, কৃষক, শ্রমিক ইত্যাদি পেশার লোকজন। এই স্কিমে চাঁদার হার চার রকম- মাসে এক হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার ও পাঁচ হাজার টাকা করে।
সমতা : এই স্কিমে চাঁদার হার একটিই – এক হাজার টাকা। তবে এক্ষেত্রে প্রতিমাসে ব্যক্তি দেবে পাঁচশ টাকা আর বাকি পাঁচশো দেবে সরকার। মূলত দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসরত স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এই স্কিম। এক্ষেত্রে দারিদ্রসীমা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। যেমন বর্তমানে বছরে যাদের আয় এখন বছরে ৬০ হাজার টাকার মধ্যে তারাই কেবল এই স্কিমের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
স্কিম কীভাবে খুলবেন?
অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা বলেন, আমরা একটা ফর্মূলা দিয়ে এই মুনাফার ব্যাপারটা ঠিক করেছি। ওখানে উল্লেখ করেছি এটা বাড়তে বা কমতে পারে। তবে আমাদের ফর্মূলা অনুযায়ী এর চেয়ে কমার সম্ভাবনা নেই।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের জন্য এই ওয়েবসাইটে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে ব্যক্তি তার জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নাম্বার ও ইমেইল দিয়ে কয়েকটি ধাপে এতে নিবন্ধন করবেন। এসময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য দরকার হবে। কেউ চাইলে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে নমিনি করতে পারবে।মাসিক চাঁদা ছাড়াও কেউ চাইলে তিন মাস পরপর বা বছরে একবার পুরো চাঁদা দিয়ে দিতে পারবে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে চাঁদা দিতে ব্যর্থ হলে তার পরের এক মাস পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া চাঁদা পরিশোধ করা যাবে। এরপর থেকে প্রতি দিনের জন্য ১% বিলম্ব ফি যুক্ত হবে। কেউ টানা ৩ কিস্তি পরিশোধ না করলে তার অ্যাকাউন্টটি স্থগিত হয়ে যাবে। তবে কেউ যদি নিজেকে অসচ্ছল ঘোষণা করে তাহলে ১২ মাস পর্যন্ত চাঁদা না দিলেও অ্যাকাউন্টটি স্থগিত হবে না। অনলাইন ও যে কোন মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে চাঁদা পরিশোধ করা যাবে। আপাতত শুধুমাত্র সোনালী ব্যাংকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের হিসাব খোলা হয়েছে। কেউ চাইলে সরাসরি সোনালী ব্যাংকে গিয়েও নিবন্ধন করতে পারবেন ও চাঁদা দিতে পারবেন।
পেনশনের সুবিধা
অনেকের মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটি হচ্ছে – পেনশন স্কিমে টাকা দিয়ে শেষ পর্যন্ত সেটি পাওয়া যাবে তো? এ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা বলেন, এটা নিয়ে শঙ্কা থাকার কোন কারণ নেই। কারণ সরকার নিজে এটার গ্যারান্টি দিচ্ছে। আর আমরা যে ইউনিক নাম্বার দেব প্রত্যেক পেনশনারকে, তারা কিন্তু ঐ নাম্বার দিয়ে সবসময় চেক করতে পারবেন তার অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে।
পেনশনারগণ আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। তবে কেউ যদি ৭৫ বছর বয়স পূরণ হবার আগেই মারা যান তাহলে তার নমিনি পেনশনারের বয়স ৭৫ হওয়া পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পাবেন। আর যদি পেনশনার ১০ বছর চাঁদা দেবার আগেই মারা যান তাহলে তার জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে। কারো যদি পেনশনে জমাকৃত অর্থ কোন এক পর্যায়ে উত্তোলনের দরকার হয় তাহলে সেই সুযোগও থাকছে। তার মোট জমার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ অর্থ তিনি আবেদনের প্রেক্ষিতে ঋণ হিসেবে নিতে পারবেন। পেনশনের জন্য প্রতিমাসে জমা দেয়া চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হবে এবং সেই অর্থ কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে। আর মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ হবে আয়কর মুক্ত।