নির্বাচন

হলফনামায় সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি, খতিয়ে দেখার দায়িত্ব কার?

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ৫:১৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৯, ২০২৩

গত কয়েকটি নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় উল্লিখিত সম্পদের হিসাব নিয়ে নানা আলোচনা- সমালোচনা হলেও, এগুলো নিয়ে খুব একটা ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এমনকি এসব তথ্য আর কোন সংস্থাকে খতিয়ে দেখার মতো পদক্ষেপও নিতে দেখা যায় না। বাংলাদেশে প্রতি বছর নির্বাচনে যারা প্রার্থী হতে চান, তাদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের তথ্য হলফনামায় উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেক প্রার্থীর সম্পদের পরিমাণ গত পাঁচ বছরে কয়েকশ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হচ্ছে। অনেকের এমপি হওয়ার পর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে বলা হচ্ছে, অনেক প্রার্থীর নিজের নামে সম্পদ দেড়-দুইগুণ বাড়লেও তাদের স্ত্রীদের নামে সম্পদের পরিমাণ ৫০-৬০ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “হলফনামায় প্রার্থীর আয়-ব্যয় সংক্রান্ত সবকিছু দেখার (খতিয়ে) সুযোগ আছে বিধায়ই এই প্রবিশনটা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা যথাযথভাবে পালন করা হয় না।”

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, যাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা হয় তারা ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।২০০৮ সাল থেকে মনোনয়নপত্রের সাথে প্রার্থীর হলফনামা জমা দেয়ার নিয়ম কার্যকর হয়। যার মধ্যে প্রার্থীর আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব, তার উপর নির্ভরশীলদের আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে। হলফনামায় দেয়া সম্পদের তথ্য অনুযায়ী, আয় ও সম্পদ বাড়ার পর তা নিয়ে সমালোচনা অবশ্য এবারই প্রথম নয়। বরং এর আগের নির্বাচনগুলোতেও অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে একই ধরনের সমালোচনা সামনে এসেছে।

সুজন ২০১৪ সালের নির্বাচন অংশ নেয়া গুরুত্বপূর্ণ ৪৮ জন প্রার্থীর ২০০৮ সালের হলফনামা ও ২০১৪ সালের হলফনামা পর্যালোচনা করেছিল। তখন প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছিল যে, বেশ কয়েক জন প্রার্থীর আয় ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ৮ হাজার গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। সবশেষ ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এতে অংশ নেয়া গুরুত্বপূর্ণ ৫৩ জন প্রার্থী- যারা দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের হলফনামার আয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন। সেখানে বলা হয়, সর্বমোট ৫৩ জন প্রার্থীর আয় গড়ে ১০৬.৭৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আয় বৃদ্ধির এই হার ১০.৯১ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১১৫২.০৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

হলফনামার কাজ কী?
নির্বাচনের আইন অনুযায়ী, প্রার্থীরা তাদের মনোনয়নপত্রের সাথে হলফনামা জমা দেন। এই হলফনামায় মোট আট ধরনের তথ্য দিতে হয়। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা ও আয়ের উৎস, মামলার বিবরণী, প্রার্থীর নিজের ও তার নির্ভরশীলদের আয়-ব্যয়, সম্পদ এবং দায় দেনা। হলফনামায় এসব তথ্য সংযোজন করে তা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দিতে হয়। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে এই হলফনামা সবার জন্য উন্মুক্ত করার নিয়ম রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের প্রার্থীদের এসব তথ্য দেয়া এবং তা প্রকাশের বাধ্যবাধকতার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোটারদেরকে তথ্য দিয়ে ওই প্রার্থী সম্পর্কে জানানো। তারা যাতে জেনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, হলফনামার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোটারদেরকে ওই প্রার্থীকে চেনা। এছাড়া এর মাধ্যমে ওই প্রার্থীর আয়ের সাথে তার সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ বা অর্থের বিকাশ ঘটেছে কিনা সেটি জানার একটা সুযোগ তৈরি হয়। এটা জানার ফলে, সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকলে, সুস্থ নির্বাচনী প্রক্রিয়া থাকলে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করে নির্বাচন হলে, তখন মানুষের একটা সুযোগ হয় সঠিক প্রার্থীকে বেছে নেয়ার। সততার সাথে বা দুর্নীতি মুক্ত হয়ে জনপ্রতিনিধিত্বের অবস্থানটাকে প্রতিপালন করছেন কিনা সেগুলো জানার সুযোগ হয়। তবে এগুলো নিয়ে নির্বাচন কমিশন সত্যিকার অর্থে তার নির্ধারিত দায়িত্বটা পালন করে না।

হলফনামা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে আসছে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন। এই প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই তথ্যগুলো ভোটারদের কাছে যাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। এই কাজ নির্বাচন কমিশনের করার কথা। কিন্তু তারা এগুলো নিয়ে ওয়েবসাইটেও ঠিক মতো দেয় না। তাদের কাছ থেকে এগুলো পাওয়াটাও দুরূহ। হলফনামায় যদি মিথ্যা তথ্য দেয়, তথ্য গোপন করে তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার কথা। এমনকি তারা নির্বাচিত হয়ে গেলে সেই নির্বাচনও বাতিল হওয়ার কথা রয়েছে। একই সাথে এটা একটা ফৌজদারি অপরাধও বটে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সচিব জাহাঙ্গীর আলম  বলেন, হলফনামার বিষয়ে তদন্ত বা কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। বরং ২০০৮ সালে হাইকোর্টের এক রায়ের পর হলফনামা যুক্ত করার বিধানটি এসেছে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে প্রার্থীদের কাছ থেকে হলফনামা সংগ্রহ করে তা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র চূড়ান্ত হবে ১৭ই ডিসেম্বর। ১৮ই ডিসেম্বরের পর এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীদের সবার হলফনামা অনলাইনে প্রকাশ করা হবে।

‘হাত পুড়ে যেতে পারে’
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, হলফনামায় বেশ কয়েকটি বিষয় দেখার রয়েছে। প্রথমত হলফনামায় যে তথ্য দেয়া হচ্ছে তা বাস্তবতার সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? দ্বিতীয়ত যে আয় ও সম্পদের হিসাব দেয়া হচ্ছে, সেটি আসলে বৈধ সূত্রের সাথে অর্জিত সম্পদের সামঞ্জস্য আছে কিনা? আর তৃতীয়ত হচ্ছে, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সময় যে হলফনামা দিয়েছিলেন তারপর থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর পরবর্তী পাঁচ বছরে তার সম্পদের বিকাশ কী পরিমাণ হয়েছে?

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই সবকিছু দেখার সুযোগ আছে বিধায়ই এই প্রবিশনটা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা যথাযথভাবে পালন করা হয় না। নির্বাচন কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে এই হলফনামাগুলো প্রকাশ করা ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব পালন করে না। হলফনামার এই তথ্য শুধু প্রার্থীদের বিষয়ে ভোটারদের ধারণা দেয়া নয় বরং আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।বিশেষ করে, যদি কোন প্রার্থীর বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির অভিযোগ থাকে, কিংবা তার হলফনামায় উল্লেখিত সম্পদের তথ্যের সাথে যদি বাস্তবতার সামঞ্জস্য পাওয়া না যায় তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে এগিয়ে আসতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বপ্রণোদিতভাবে নিজেদের ক্ষমতাবলেই এই কাজগুলো করতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশন তো একটা প্যাসিভ অর্গানাইজেশন হওয়ার জন্য তৈরি করা হয় নাই। তার আইনে এখতিয়ার আছে। কেউ অভিযোগ করতে হবে এমন কোন কথা নেই।দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য কিছু কিছু ব্যক্তি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শতগুণ বা তার চেয়ে বেশি সম্পদের বিকাশ ঘটেছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করুক, তদন্ত করুক। রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাগুলোও এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে দেখতে পারে যে কর ফাঁকির কোন বিষয় এর সাথে যুক্ত কিনা। বিশেষ করে তাদের আয়কর বিবরণীর সাথে এসব সম্পদের মিল আছে কিনা, সেটা যাচাই করে ব্যবস্থা নিতে পারে। এই ধরনের প্রক্রিয়াগুলো আসলে হয় না কারণ যাদের সম্পর্কে এই অভিযোগগুলো আসছে তারা ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট। ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে হাত দিলে হাত তো পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে বলে অনেকে মনে করেন। এ কারণেই এরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

দুর্নীতি দমন কমিশন স্বপ্রণোদিতভাবে নিজেদের ক্ষমতাবলেই হলফনামা নিয়ে কাজ করতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

যা বলছে দুদক
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে সময় কয়েকজন প্রার্থীর হলফনামায় দেয়ার তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছিলো। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, হলফনামার তথ্য নিয়ে কাজ করার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাথে তাদের আলোচনা হয়েছিল। তাদের পর্যালোচনাকৃত তথ্য ব্যবহার করে তদন্ত শুরুরও কথা ছিল। কিন্তু সেগুলো আর শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

দুদকের কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক বলেন, কারো সম্পদ বাড়লে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয় না। যদি কারো অবৈধ সম্পদ বাড়ে তাহলে সেটি নিয়ে তদন্ত করা হয়। তবে তদন্ত শুরু করার জন্য আগে তার বিরুদ্ধে দুদকে কারো অভিযোগ দায়ের করতে হয়। হলফনামায় সম্পদের যে হিসাব দেয়া হয় তা আসলে বৈধ সম্পদের হিসাব। যদি অবৈধ সম্পদের তথ্য আসে, হলফনামায় দেয় সব বৈধ সম্পদ, অবৈধ সম্পদ হলে আমরা দেখবো। অবৈধ না হলে আমাদের এখতিয়ার নাই। তবে কখনো কখনো দুদকের স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে পদক্ষেপ নেয়ার এখতিয়ার রয়েছে। সেক্ষেত্রে দুদকের কাছে তথ্য আগে আসতে হবে যে, সম্পদগুলো আসলে অবৈধ। অভিযোগ না আসলে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।