ধর্মকথা

‘হালাল সনদ নীতিমালা’ আসলে কী? এ সনদের কেনো প্রয়োজন হলো?

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ৮:১৭ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৫, ২০২৩

বাংলাদেশে সম্প্রতি ইসলামী শরিয়া মোতাবেক পণ্য উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি ও বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে ‘হালাল সনদ নীতিমালা-২০২৩’ নামে একটি নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সরকার। নীতিমালা অনুযায়ী, এখন থেকে কোন পণ্যের হালাল স্বীকৃতি পেতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাছে আবেদন করে হালাল সনদ ও লোগো নিতে হবে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বলছে, প্রাথমিকভাবে খাদ্যদ্রব্য, ভোগ্যপণ্য, ওষুধ এবং প্রসাধনসামগ্রীর ক্ষেত্রে এ নীতিমালা প্রযোজ্য হবে ।

সংস্থার হালাল সনদ বিভাগের উপ-পরিচালক মোঃ আবু ছালেহ পাটোয়ারী বলেছেন, খাদ্য, ভোগ্যপণ্য, প্রসাধনী এবং ওষুধের উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়া যেন মেনে চলা হয়, সেটি নিশ্চিত করতেই এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরবসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট অনেক দেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে হালাল সনদ থাকা বাধ্যতামূলক। ফলে সরকারের এই পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন রপ্তানিকারকদের অনেকে। এর আগে ২০২১ সালে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন বা বিএসটিআই মূলত মুসলিম প্রধান দেশগুলোর রপ্তানি বাজার ধরার লক্ষ্য নিয়ে প্রথম দেশীয় খাদ্যপণ্য এবং প্রসাধন সামগ্রীকে হালাল সার্টিফিকেট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে হালাল নীতিমালা প্রণয়নের ঘটনা প্রথমবার হলো বাংলাদেশে।

হালাল সনদ কী?
ইসলামী শরিয়া আইনে মানুষের ভোগ বা ব্যবহারের জন্য যেসব পণ্যকে বৈধ করা হয়েছে, তাকে সাধারণভাবে হালাল পণ্য বলে। হালাল সনদ বলতে সাধারণভাবে শরিয়া মেনে পণ্য উৎপাদন করা হয়েছে তার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিকে বোঝায়। এই মুহুর্তে বিশ্বে হালাল পণ্যের বাজার প্রায় তিনশো কোটি মার্কিন ডলারের মত। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়ায় এখানে হালাল পণ্যের যেমন বিশাল চাহিদা রয়েছে, তেমনি বিদেশে রপ্তানিরও ব্যাপক সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বলছে, বাংলাদেশে যেসব প্রতিষ্ঠান হালাল পণ্য উৎপাদক, আমদানি, রপ্তানি ও বাজারজাত করতে চায়, তাদের সুবিধার্থেই নতুন এই নীতিমালা করা হয়েছে । ‘হালাল সনদ নীতিমালা-২০২৩’ অনুযায়ী, সরকারের পক্ষ থেকে পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে হালাল সনদ ও লোগো প্রদান করবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির কর্মকর্তা আবু ছালেহ পাটোয়ারী বলছেন, পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে মুসলিম দেশুগুলোর অনেকে হালাল সনদ চায়। ফলে বাংলাদেশ থেকে যারা ওইসব দেশে হালাল পণ্য রপ্তানি করতে আগ্রহী, তাদের সুবিধার্থেই মূলত: এই নীতিমালা করা হয়েছে।

হালাল সনদের বিষয়ে মুসলিম বিশ্বের জোট ওআইসির যেসব নির্দেশনা রয়েছে, প্রধানত সেটি অনুসরণ করছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এছাড়া বিভিন্ন সময় তুরষ্ক এবং মালয়েশিয়ায় প্রচলিত ব্যবস্থাকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন। নভেম্বরের ২১ তারিখে নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। তবে, এই নীতিমালা প্রকাশের আগে ২০০৭ সাল থেকেই হালাল সনদ দিয়ে আসছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। তবে সেটি মূলত যারা মুসলিম দেশগুলোতে হালাল পণ্য রপ্তানি করছেন সেসব ব্যবসায়ীদের চাহিদার প্রেক্ষিতে করা হতো।

আবু ছালেহ পাটোয়ারী বলেন, এতদিন আমরা সরকারের বিশেষ আদেশে এটি (সনদ) ইস্যু করতাম। এখন নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে সনদ ইস্যুর ক্ষমতা দেওয়া হলো। তবে রপ্তানি বা দেশীয় বাজারে পণ্য উৎপাদন, বিপনন বা বাজারজাতকরণের জন্য এ নীতিমালা বাধ্যতামূলক নয়। হালাল সদন পেতে হলে পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের ফি জমা দিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাছে আবেদন করতে হবে।

নীতিমালায় যা আছে
নীতিমালায় বলা হয়েছে যে, যারা হালাল পণ্য উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি এবং বাজারজাত করতে চান, তারা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাছে সনদ ও লোগোর জন্য আবেদন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে শরিয়া আইন মেনে পণ্য উৎপাদন, বিপনন বা বাজারজাতকরণ হচ্ছে কী-না সেটি মনিটর করবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, সন্তুষ্ট হলেই কেবল কোন কোম্পানি পাবে হালাল সনদ। তবে প্রাথমিকভাবে সনদের মেয়াদ হবে এক বছর। মেয়াদ শেষে কোন প্রতিষ্ঠান আবার সনদের জন্য আবেদন করলে, তাদের পারফর্ম্যান্স এবং কারখানার মান বিবেচনায় মেয়াদ দুই থেকে তিন বছর বাড়ানো হতে পারে। এক্ষেত্রে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের আকার ও সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে হালাল সনদ ও লোগোর জন্য একটি বার্ষিক ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

এক থেকে পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে এমন ছোট কারখানার ক্ষেত্রে হালাল সনদ ফি পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে। আর পাঁচ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের কারখানার জন্য এই ফি দ্বিগুণ, অর্থাৎ ১০ হাজার টাকা। এছাড়া ৫০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগে করা বড় কারখানার ক্ষেত্রে ২০ হাজার টাকা ফি দিতে হবে। এছাড়া দেশি হোটেল ও রেস্টুরেন্টের প্রতি ইউনিট রান্নার জন্য হালাল সনদ ফি এক হাজার টাকা এবং আন্তর্জাতিক হোটেলের প্রতি ইউনিট রান্নার জন্য দুই হাজার টাকা ফি দিতে হবে। এর বাইরে, জবাইখানা বা কসাইখানার সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে এক থেকে পাঁচ টন মাংস হলে পাঁচ হাজার টাকা, পাঁচ থেকে ১০ টন মাংস হলে ১০ হাজার টাকা এবং ১০ টনের বেশি হলে ২০ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

নীতিমালা অনুযায়ী, হালাল সনদের মেয়াদকালে হালাল খাদ্য, পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, পরিবেশনের নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে কী-না, সেজন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন বছরে অন্তত একবার কারখানা পরিদর্শন করবে। খাদ্যপণ্য, প্রসাধনী ও ওষুধ তৈরি এবং মোড়কজাত প্রক্রিয়ায় ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী হালাল নয় এমন কোন কাঁচামাল, উপাদান বা উপকরণ ব্যবহার করা যাবে না। ওষুধের উপাদান বিশ্লেষণ করে শুধু হালাল ও ঝুঁকিহীন হলেই হালাল হিসেবে অনুমোদন দেবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। হারবাল, ইউনানি এবং আয়ুর্বেদিক ওষুধ হালাল সনদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হলে ও পরিশোধিতভাবে পরিবেশিত হলে তা হালাল হিসেবে গণ্য করা হবে। ওষুধের বাহন হিসেবে বা গুণগত মান ঠিক রাখতে সর্বোচ্চ দশমিক পাঁচ শতাংশ অ্যালকোহল ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া নীতিমালায় সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট ও পারফিউমের মতো প্রসাধনী তৈরিতে চর্বি বা অন্য কোনো নিষিদ্ধ প্রাণীর অংশ ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। আর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো প্রসাধনী পণ্য হালাল হিসেবে গণ্য হবে না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই ১৯২টি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে হালাল সনদ দিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। হালাল পণ্য তৈরি ও বিপণনের অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৬২টি প্রতিষ্ঠান দুইশোর বেশি পণ্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। এর মধ্যে প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্য যেমন রয়েছে, তেমনি প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসও রয়েছে। তবে পণ্যের মান যাচাইয়ের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিজস্ব কোন পরীক্ষাগার নেই। যদিও, ২০১৭ সালে তারা ঢাকার আগারগাঁওয়ে নতুন একটি ল্যাবের অবকাঠামো তৈরি করেছে, তবে, তাতে মান নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কোন যন্ত্রপাতির সংস্থান এখনো হয়নি বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া লোকবলেরও ঘাটতি আছে। ফলে নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হতে বলে মনে করেন আবু ছালেহ পাটোয়ারী।

ব্যবসায়ীরা কী বলছেন?
হালাল সনদ প্রদানের বিষয়টিকে ইতিবাচক বলে বর্ণনা করেছেন ব্যবসায়ীদের অনেকে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় মাংস উৎপাদক ও রপ্তানিকারক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল মিটের বিপণন ও রপ্তানি শাখার প্রধান আল আমিন বলেছেন, হালাল সনদের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলো এটি চায়। আমাদের দাবি আমলে নিয়ে সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, একে আমরা সাধুবাদ জানাই।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২০১৫ সালে ‘হালাল সনদ নীতিমালা’ তৈরির উদ্যোগ নেয়। সে বছর নীতিমালার খসড়াও তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। শেষ পর্যন্ত এ বছর নভেম্বরে নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।