প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে গত বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) উদ্বোধন হলো সর্বজনীন পেনশন স্কিম। এর মাধ্যমে দেশের সব শ্রেণীর পেশাজীবী মানুষ একীভূত হতে যাচ্ছে এই সুপরিকল্পিত পেনশন স্কিমের আওতায়। বিশেষ করে দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকেরা। বাংলাদেশের বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য স্বতন্ত্র একটি প্যাকেজ আছে মূল স্কিমের অধীনে। ‘প্রগতি’ নামের এই স্কিমটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটিরও স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণের সুবিধা রাখা হয়েছে। আজকে আলোচনা করা হবে বাংলাদেশের বেসরকারি চাকুরিজীবীরা কিভাবে প্রগতি স্কিম বা প্যাকেজে নিবন্ধন করতে পারবেন।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম ২০২৩-এর সাধারণ নিয়মাবলি
৩১ জানুয়ারি, ২০২৩-এ প্রণীত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩-এর অধীনে গঠন করা হয়েছে এই স্কিম। এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের নিমিত্তে নির্ধারণ করা হয়েছে কিছু নিয়মাবলি, যেগুলো বেসরকারি কর্মজীবীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জাতীয় পরিচয়পত্র বা ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড (এনআইডি) অনুসারে এই স্কিমে অংশগ্রহণের বয়সসীমা সর্বনিম্ন ১৮ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ বছর পর্যন্ত। ৫০ বছর বয়সের পরের নাগরিকরা বিশেষ বিবেচনায় স্কিমটি নিতে পারবেন, তবে তার মেয়াদ থাকবে ১০ বছর। অর্থাৎ টানা ১০ বছর চাঁদা প্রদানের পর থেকে তিনি আজীবন পেনশন পাওয়ার জন্য যোগ্য হবেন। স্কিম নেওয়ার জন্য অবশ্যই অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীরা এই স্কিম নিতে চাইলে তাদের আগের সেই সুবিধাগুলো বাদ দিয়ে আসতে হবে। স্কিম চালু হওয়ার সময় থেকেই প্রত্যেক চাঁদা প্রদানকারির নামে একটি আলাদা অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করা হবে। পেনশন পাওয়া অবস্থায় ৭৫ বছর বয়সের আগেই পেনশন গ্রহণকারী মারা যেতে পারেন। এমতাবস্থায় তার নমিনি বা মনোনীত উত্তরাধিকার বাকি সময়গুলোর পেনশন পাবেন। এই অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থাটি চাঁদা প্রদান করার সময়েও হতে পারে। সেক্ষেত্রে নূন্যতম ১০ বছরের স্কিম শেষ না করেই যদি চাঁদা প্রদানকারীর মৃত্যু হয়, তাহলে জমাকৃত চাঁদার অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনি পাবেন। পেনশন পাওয়ার উদ্দেশ্য চাঁদা হিসেবে জমা করা টাকা বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু পরবর্তীতে মাসিক পেনশন গ্রহণের সময় গ্রহণকারিকে পেনশনের উপর কোনও আয়কর দিতে হবে না। সরকারি বিভিন্ন সেবার জন্য সেবা গ্রহণকারিকে ০.৭০ (শূন্য দশমিক সাত) শতাংশ ক্যাশ আউট চার্জ দিতে হয়। এই স্কিমের ক্ষেত্রেও, মোবাইলের মাধ্যমে চাঁদা দেয়ার সময়ে চাঁদা প্রদানকারির প্রতি হাজারে ৭ টাকা খরচ করতে হবে।
উল্লেখ্য, ১৬ আগস্ট বুধবার অন্যান্য সরকারি সেবার মত এই স্কিমেও মোবাইল আর্থিক সেবার জন্য অভিন্ন সার্ভিস চার্জটি ঠিক করা হয়।
প্রগতি : বেসরকারি চাকরীজীবীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম
প্রগতি স্কিম বা প্যাকেজে কিস্তিতে কত টাকার বিনিময়ে কত টাকা পেনশন পাবেন। বেসরকারি কর্মচারি বা কর্মকর্তা উপরোক্ত হারে চাঁদা প্রদানের ভিত্তিতে যুক্ত হতে পারেন প্রগতি স্কিমের সঙ্গে। এখানে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি তথা কোম্পানির মালিক প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও নিতে পারে প্রগতি স্কিম। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পেনশনের জন্য উল্লেখিত চাঁদার পরিমাণ কোম্পানি তার কর্মচারির সাথে সমান ভাবে ভাগাভাগি করে নিবে। অর্থাৎ প্রতি কিস্তির পুরো টাকা কর্মচারিকে একা দিতে হবে না। অর্ধেক দিবে কর্মচারি এবং অর্ধেক দিবে কোম্পানি।
বেসরকারি চাকরীজীবীদের সর্বজনীন পেনশন প্রগতি স্কিম-এ নিবন্ধন পদ্ধতি
বেসরকারি কর্মজীবীসহ অন্যান্য সকল পেশার বাংলাদেশি নাগরিককে ইউপেনশন ওয়েবসাইট-এর মাধ্যমে স্কিমে নিবন্ধন করতে হবে। সাইটটিতে যেয়ে সরাসরি ক্লিক করতে হবে পেনশনার রেজিস্ট্রেশন-এ।
প্রাথমিক শর্তাবলীতে সম্মতি জ্ঞাপন
প্রথম কাজ পরিচয় নিশ্চিত করার মাধ্যমে নিবন্ধনের প্রাথমিক শর্তে সম্মতি দেওয়া। এখানে নিম্নোক্ত শর্তাবলিতে সম্মতি জ্ঞাপন ছাড়া পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হওয়া যাবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বা স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি কিংবা আধা-সরকারি কোনও প্রতিষ্ঠানের কর্মরত হওয়া যাবে না। এই স্কিমের বাইরে কোনও স্বায়ত্তশাসিত অথবা সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও ধরণের সুবিধা ভোগকারি হওয়া যাবে না। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় কোনও ধরনের ভাতা গ্রহণকারী হওয়া যাবে না। শর্তগুলোর নিচে ‘আমি সম্মত আছি’ বাটনে ক্লিক করে পরের পাতায় যেতে হবে। ভুল তথ্য দিয়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদন বাতিল করা হবে। এমনকি চাঁদা প্রদানের সময় আবেদনের তথ্যে ভুল প্রমাণিত হলে, সেই অর্থ ফেরত দেয়া হবে না।
আয়ের শ্রেণী নির্বাচন
এ অংশে মুল স্কিম তথা আয়ের শ্রেণী বাছাই করতে হবে। বেসরকারি চাকরীজীবীরা প্রগতি ক্যাটাগরিটি নির্বাচন করবেন। অতঃপর একে একে ১০, ১৩ বা ১৭ অঙ্কের এনআইডি সংখ্যা, জন্ম তারিখ, মোবাইল নাম্বার এবং ই-মেইল আইডি প্রবেশ করাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গেই প্রার্থীর মোবাইল নাম্বারে ও ই-মেইল ঠিকানায় একটি ওটিপি (ওয়ান-টাইম-পাসওয়ার্ড) পাঠানো হবে। এটি অনলাইন ফর্মের নির্ধারিত শূন্যস্থানে নির্ভুলভাবে বসাতে হবে। এবার নিচের দিকে থাকা ক্যাপচাটি নির্ভুলভাবে পূরণ করতে হবে।
ব্যক্তিগত তথ্যাবলী
পরবর্তীতে ওয়েবপেজে প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহ করতে হবে। তথ্যগুলো হচ্ছে এনআইডি সংখ্যা, ছবি, বাংলা ও ইংরেজিতে সম্পূর্ণ নাম, পিতা ও মাতার নাম, এবং বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা। যেহেতু ইতোমধ্যে এনআইডি সংখ্যা একবার দেওয়া হয়েছে, সেহেতু এখানে তথ্যগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হয়ে যাবে। উপজেলা, জেলা ও বিভাগের নামগুলো ড্রপ ডাউন লিস্ট থেকে নির্বাচন করে নিতে হবে।
পেশার তথ্যাবলী
পেশার সেকশনে কয়েকটি পেশার নাম উল্লেখ করা থাকবে। সেগুলোর ভেতর থেকে বেসরকারি চাকরীজীবী নিজের পেশাটি বাছাই করে দিবেন। বার্ষিক আয়ের শূণ্যস্থানটিতে টাইপ করে সংখ্যায় লিখে দিতে হবে।
স্কিম তথ্য
এই পাতায় প্রার্থী মাসে কত করে চাঁদা দিবেন এবং কিভাবে দিবেন তা ঠিক করা হবে। চাঁদা পরিশোধের ধরণ তিনটি: মাসিক, ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক। এগুলো থেকে যে কোনও একটিকে প্রার্থী নিজের সুবিধা মত বেছে নিবেন। তারপর দিতে হবে চাঁদা পরিশোধের উপায় তথা ব্যাংকের তথ্য। এখানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হোল্ডার অর্থাৎ প্রার্থীর নাম বা যার অ্যাকাউন্ট থেকে চাঁদা পরিশোধ করা হবে তার নাম ও অ্যাকাউন্ট নাম্বার সরবরাহ করতে হবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ধরণ হিসেবে সঞ্চয়ী ও চলতি থেকে যে কোনও একটি বাছাই করে দিতে হবে। তারপর দিতে হবে ব্যাংকের রাউটিং নাম্বার। এর মাধ্যমে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তর হয়। নাম্বারটি জানা না থাকলে গুগল সার্চ ইঞ্জিন-এ সার্চ করে সহজেই জেনে নেয়া যেতে পারে। এছাড়া, এই অনলাইন ফর্ম থেকে না বের হয়েও শুধুমাত্র পাশের ‘রাউটিং নম্বর জানা নাই’ বাটনেও ক্লিক করা যেতে পারে। এতে চটজলদি ছোট্ট একটি বক্স হাজির হয়ে ব্যাংক ও ব্যাংকের শাখার নাম জানতে চাইবে। এই তথ্যগুলো সঠিক ভাবে দেয়া হলে সাথে সাথেই রাউটিং নাম্বারটি আপনাতেই নির্ধারিত স্থানে আপডেট হয়ে যাবে।
নমিনি পাতা
পরের পাতায় এসে নমিনির যাবতীয় তথ্য তথা- তার এনআইডি নাম্বার ও জন্ম তারিখ দেয়া লাগবে। এরপর নিচের ‘নমিনি যুক্ত করুন’ বাটনের মাধ্যমে অন্যান্য তথ্যের অংশ উন্মুক্ত হবে। এখানে নমিনির মোবাইল নাম্বার ও প্রার্থীর সঙ্গে তার কি সম্পর্ক তার পাশাপাশি তিনি প্রার্থীর অংশের কতটুকু পাবেন তা উল্লেখ করতে হবে। একাধিক নমিনি না থাকলে একজনই প্রার্থীর সম্পূর্ণ অংশের নমিনি হবেন। আরো নমিনি যুক্ত করুন’ বাটনটি একাধিক নমিনির জন্য। এর মাধ্যমে একাধিক নমিনি যুক্ত করে তাদের প্রাপ্য অংশটুকু উল্লেখ করে দিতে হবে।
তথ্য যাচাই ও নিবন্ধনের শেষ ধাপ
সম্পূর্ণ ফরমে ক্লিক করার পর এই পাতায় ব্যক্তিগত, স্কিম, ব্যাংক ও নমিনি সব তথ্য একসাথে দেখানো হবে। এগুলো এক নজরে দেখে নিয়ে নির্ভূল তথ্যের ব্যাপারে সম্মতি দিলেই শেষ হবে নিবন্ধন প্রক্রিয়া। পূরণকৃত সম্পূর্ণ আবেদনটি ডাউনলোড করে পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা যেতে পারে।
প্রগতি স্ক্রিমে পেনশনের চাঁদা জমা দেওয়ার উপায়
আবেদনপত্রে সরবরাহকৃত মোবাইল নাম্বার ও ই-মেইল ঠিকানায় সময় মত নিবন্ধনকারির চাঁদার হার এবং মাসিক চাঁদা দেওয়ার তারিখ জানানো হবে। কিস্তি অনুযায়ী ধার্য চাঁদার টাকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা দিতে হবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। কোনও কারণে এই সময়ে চাঁদা দেয়া সম্ভব না হলে, পরবর্তী সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে জরিমানা ছাড়াই চাঁদা দেওয়া যাবে। এই এক মাসের সময়সীমাটি অতিক্রম হলে পরবর্তী প্রতিদিনের জন্য জরিমানা দিবে হবে ১ শতাংশ হারে। অন্যথায় স্কিম অ্যাকাউন্টটি অচল হয়ে যাবে।
জাতীয় আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এগুলো প্রতি বছরই যোগান দিচ্ছে বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠি। এই জনসম্পদকে আর্থিক অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেয়ার মত আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে বয়স্ক জনগোষ্ঠির বর্ধমান পরিসংখ্যানটি। সেখানে এই ‘প্রগতি’ স্কিমটি হতে পারে চূড়ান্ত মুক্তির উপায়। বেসরকারি চাকরীজীবীরা সর্বজনীন পেনশন স্কিম-এর প্রগতি প্যাকেজে রেজিস্ট্রেশন করলে, এটি ভবিষ্যতে বার্ধক্যের সময় তাদের স্বনির্ভর করবে।