আন্তর্জাতিক

‘প্রতি রাতে আমাকে ১০ জন পুরুষের সাথে শুতে হতো’

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৩, ২০২৩

‘একবার আমার খালা ভারত থেকে ঈদের সময় আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। সে আমার মাকে বলে যে, আমাকে ভারতে নিয়ে গিয়ে একটা চাকরি দেবে। আমাদের সংসারে আর অভাব থাকবে না। কিন্তু আমাকে সেখানে নিয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। প্রতিদিন দশ জন লোক আমার দেহ আঁচড়ে খেয়েছে।’

এই কথাগুলো বলছিল বাংলাদেশ থেকে ভারতের গুজরাটে আসা এক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে। কাজ এবং উপার্জনের আশায় অবৈধ পথে এই মেয়েটি ভারতে এসেছিল। সম্প্রতি তাকে গুজরাট থেকে আবার বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে তার পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। এর পরিবর্তে ছদ্মনাম হিসেবে এখানে সালমা নামটি ব্যবহার করা হচ্ছে। সালমার সাথে কথা বলার সময় বোঝা যাচ্ছিল যে, অনেক কম বয়সে খুব তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।

বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার আগে সালমা দুবছর ছিল ‘জাগরুত মহিলা সংস্থা’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে। এরা তাকে চিকিৎসা এবং কাউন্সেলিং সেবা দিয়ে নতুন করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এরাই সালমাকে বাংলাদেশে তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে। সালমা গুজরাট ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে গেছে, কিন্তু এই বয়সেই যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেটি হয়তো তার বাকি জীবনেও পূরণ হওয়ার নয়। ঘরে ফিরে যাবার আগে যে গল্প সে বিবিসি গুজরাটিকে বলেছে, তা ছিল খুবই হৃদয় বিদারক।

‘জাগরুত মহিলা সংস্থার প্রেসিডেন্ট আশাভান দালাল জানান, পুলিশ প্রায় আড়াই বছর আগে সালমাকে তার অফিসে নিয়ে আসে। পুলিশ সালমাকে স্থানীয় একটি বাসস্ট্যান্ডের কাছে খুবই বিচলিত অবস্থায় দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে।

আশাভান বলেন, “সে যখন আমার অফিসে আসে, তখন সে চুপচাপ হয়ে একটা কোণে বসে থাকতো। আমরা চিকিৎসা করি। ধীরে ধীরে সে কথা বলতে শুরু করে। সে যখন নিজের সম্পর্কে বলা শুরু করে তখন আমরাই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।”

সালমার গল্প শুরু হয় বাংলাদেশে। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করার কারণে, ভারতে নিয়ে এসে সালমাকে তার এক আত্মীয় পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে, যাকে সে খালা বলে ডাকতো। সালমা বলে, ‘আমার খালা ঈদে আমাদের বাড়িতে এসে আমার মাকে অনেক কিছু উপহার দেয়। আমি আর আমার মা খুব খুশি ছিলাম। সে আমার মাকে বলে যে, আমি যদি তার সাথে ভারতে যাই, তাহলে সেখানে আমি চাকরি পাবো। খালা তখন বলেছিল যে, ভারতে সেও অনেক টাকা আয় করে। সে আমার মাকে বলেছিল যে, এখানে মানুষ অন্যের বাসায় কাজ করেও অনেক টাকা আয় করতে পারে। আমরা মনে করেছিলাম যে, চাকরি পেলে আমাদের অভাব দূর হবে। আর আমরা সেটাই করলাম।

তখন সালমার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। তার খালা তাকে অবৈধভাবে ভারতে নিয়ে যায়। সালমা বলে যে, ভারতে প্রবেশ করার সাথে সাথে তার খালার আচরণ বদলে যায়। সালমা বলে যে ভারতে পৌঁছানোর পর তার খালা বলে, “তোমার পাসপোর্ট নেই। তুমি এখানে অবৈধভাবে এসেছ। আমি যেখানে কাজ দিবো, তোমাকে সেখানেই যেতে হবে, তা না হলে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরবে।”

সালমা হিন্দি জানতো না। কিন্তু সে কোন না কোন ভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, সে সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে।

সালমা বলে, একদিন আমার খালা আমাকে একটি হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে সে আমাকে একজন লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমি জানি না তাদের মধ্যে কী কথা হয়, কিন্তু খালা বলে যে, ভারতে থাকতে হলে তাকে আমার টাকা দিতে হবে।

সালমা তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে, সে কিভাবে তার মায়ের কাছে টাকা পাঠাবে যদি সে বেতন না পায়।

অনেক সময় ১৮ জন পুরুষের সাথে রাত যাপন করতে হতো
সেখান থেকেই সালমার সমস্যার শুরু। সে খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারে যে তাকে বিক্রি করা হয়েছে। এরপর প্রতি রাতেই হতো তার নিজের বিকিকিনি। সেই সব ভয়ংকর দিনগুলোর কথা মনে করে সালমা বলেন, প্রতি রাতে তারা আমার দেহ আঁচড়ে খেয়েছে। অনেক সময় আমাকে ১০ জনের সাথে শুতে হতো, কখনো কখনো ১৮ জনের সাথেও থাকতে হয়েছে। এর বিনিময়ে আমি যা পেয়েছি তা হলো খাবার আর ঘুমানোর জায়গা। অনেক সময় খদ্দেররা বকশিস দিতো, আর সেটাই ছিল আমার একমাত্র উপার্জন। নিয়োগকর্তা আমাকে বলতো যে, সে আমার টাকা আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতো। কিন্তু পরে সালমা জানতে পারে যে, তার মা কোন টাকা পায়নি। দেহ ব্যবসাটা অনেক সময় ফাঁদ এর মতো। সে সেখান থেকে পালাতে চাইতো, আবার পুলিশের কাছে ধরা পড়ারও ভয় ছিল। কিন্তু একদিন সালমা যে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল সেটি পেয়ে যায়।

সে বলে, একদিন হোটেলে কোন খদ্দের আসেনি। এই সুযোগে আমি হোটেল থেকে বেরিয়ে যাই এবং পালিয়ে একটি বাস-স্ট্যান্ডে গিয়ে পৌঁছাই।পুলিশের চোখ এড়াতে আমি লুকিয়ে পড়ি, কিন্তু আশেপাশের লোকজন মনে করে যে আমি চোর এবং তারাই আমাকে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।

সালমাকে যখন পুলিশ ধরে তখন সে তার নাম বলেনি। কিন্তু তার অবস্থা দেখে পুলিশ তাকে মহিলা আশ্রমে নিয়ে যায়। অনেক নিপীড়িত নারী ওই প্রতিষ্ঠানটিতে বাস করতো যেখানে তাদেরকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করা হতো। এই প্রতিষ্ঠানে আসার পর নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে সালমা বলে, এখানে এসে মনে হচ্ছে আমি বাড়িতে এসেছি, কিন্তু এখনো আমি পুলিশকে ভয় পাই।এখানকার ভাল ব্যবস্থাপনা দেখে, আমি ধীরে ধীরে তাদের আমার বিষয়ে, আমার যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলতে শুরু করি। আমি তাদের এটাও বলেছি যে, আমি বোকা নই, আমি পুলিশের ভয়ে কিছু বলিনি। এই সংস্থার সংগঠক সালমাকে তার অন্ধকার জীবনে আলো দেখানোর চেষ্টা করছেন। এখানে তাকে একজন মনোবিজ্ঞানীর মাধ্যমে কাউন্সেলিং ও চিকিৎসা দেয়া হয়।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আশাভান বলেন, সালমার আসল অবস্থা জানার পর আমরা পুলিশকে জানিয়েছে, সরকারকে জানিয়েছে, বাংলাদেশের দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে এবং তাকে তার বাড়িতে পাঠানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। তাদের সহায়তায় আমরা তার মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছি। তার মাকে মেয়ের এই দুরবস্থার কথা জানানো হয়েছে। সে তার জীবনে প্রথমবারের মতো পাসপোর্ট তৈরি করে তার মেয়ের সাথে দেখা করতে আসছে।

সালমা দুই বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে যেখানে সে এমব্রয়ডারি, সেলাই এবং কৃত্রিম গয়না তৈরি করতে শিখেছে। সালমা তার তৈরি করা পণ্য বিক্রি করে দুই লাখ রুপি আয় করেছে। সালমা যখন তার মায়ের সাথে বাংলাদেশে ফিরে যায়, এই প্রতিষ্ঠানটি তার আয় করা দুই লাখ রুপি তাকে দিয়ে দিয়েছে। এদিকে, সালমার খালাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এখন সালমা বাড়ি ফিরেছে। গুজরাটে তার তিক্ত স্মৃতিগুলো ভালোবাসা আর আদরে অনেকটাই ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করেছে।


সূত্র : বিবিসি বাংলা