‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ (মোদী থাকলে সবই সম্ভব)- ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে এটাই ছিল গেরুয়া শিবিরের স্লোগান।এবছরের মে মাসে কর্নাটকে এবং গতবছরের শেষ নাগাদ হিমাচল প্রদেশে ভরাডুবির পর ভারতের পাঁচ রাজ্যে সদ্য অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে তিনটি হিন্দিভাষী রাজ্যেই বিজেপি-র জয়ের কৃতিত্বও তাদের নেতা নরেন্দ্র মোদীর ঝুলিতেই দিচ্ছে দলটি। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়- এই তিন রাজ্যের মধ্যে প্রথমটি ছাড়া বাকি দুটিতেই আবার কংগ্রেসকে হটিয়ে সরকার গঠন করছে তারা। ভারতে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি থাকতে ‘সেমিফাইনালে’ এই জয় গেরুয়া শিবিরের আত্মবিশাস দৃঢ় করেছে । কিন্তু প্রশ্ন হলো ‘সেমিফাইনালের এই ট্রেন্ড’ আসন্ন লোকসভা ভোটেও বজায় থাকবে কি?
সেমিফাইনালে ৩-১
বিধানসভা ভোটে তেলেঙ্গানাতে গেরুয়া শিবিরে তাদের পদ্ম ফোটাতে না পারলেও ‘হিন্দি বেল্টে’ বিপুল জয় হয়েছে বিজেপির। মধ্যপ্রেদেশে ২৩০টির মধ্যে বিজেপি জিতেছে ১৬৩টি, কংগ্রেস ৬৬। অন্যদিকে ছত্তীশগঢ়ে ৯০টি আসনের মধ্যে বিজেপির দখলে ৫৪টি। দুটি আসনেই গতবারের তুলনায় বিজেপির ভোট কিছুটা বেড়েছে। রাজস্থানের ১৯৯টি আসনের মধ্যে ১১৫টি বিজেপির দখলে আর কংগ্রেস পেয়েছে ৬৯টি আসন। তেলেঙ্গানায় ১১৯টি আসনের ৬৫টি কংগ্রেসের ঝুলিতে। সেখানে কংগ্রেসের ভোট যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বিজেপির ভোটও। মোটের উপর বিশ্লেষকদের মতে লোকসভা ভোটের আগে, ‘সেমিফাইনালে’ বিজেপির ৩-১ এর এই জয় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ইতিমধ্যে একাধিক বিরোধীদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে দলটিকে। মোদী-আদানি সম্পর্ক, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, মূল্যবৃদ্ধি, সীমান্তে চীনের অনুপ্রবেশ, একাধিক বিষয় নিয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের বিবাদের মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধীরা সরব থেকেছেন। এসবের মধ্যেই এই জয়কে মি. মোদী নিজেই ‘ঐতিহাসিক’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
হ্যাটট্রিকের গ্যারান্টি
এর আগে, হিমাচলপ্রদেশ ও কর্ণাটকের নির্বাচনে বিজেপি ভাল ফল না করতে পারায়, বিরোধী দলগুলোর যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, এই তিনটি জয়ের পর সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে বলেই মনে করছে ক্ষমতাসীনরা। সেই বিশ্বাস থেকেই মি. মোদী আরও একবার ‘হ্যাটট্ট্রিক’-এর ‘গ্যারান্টি’ দিয়েছেন। ফল ঘোষণার পরে তিনি বলেছিলেন, “আজকের হ্যাটট্ট্রিক ২০২৪-এর হ্যাটট্ট্রিক-এর গ্যারান্টি দিয়ে দিয়েছে”। সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে দেখতে পাওয়া তথাকথিত ‘মোদী ম্যাজিক’-রেশ কাটার আগেই ২০২৪ এর লোকসভা ভোট হোক এমনটাই চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। সে কারণেই, ভোট এগিয়ে আনার একটি চিন্তার রয়েছে ক্ষমতাসীনদের, এমন কথাও আসছে ভারতীয় গণমাধ্যমে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
প্রসঙ্গত, রাজস্থান আর ছত্তিশগড়ে বিজেপি গেরুয়া পতাকা তুললেও সে অর্থে কংগ্রেসের ভোট ২০১৮-তুলনায় সে অর্থে বিশেষ কমেনি আর মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের ভোট প্রায় নয় শতাংশ কমলেও বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক বাড়ার কারণ অন্য। মনে করা হচ্ছে, বিএসপি-সহ অন্যান্য দলগুলির ভোট নিজেদের দিকে টেনে লাভবান হয়েছে গেরুয়া শিবির।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র। তিনটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি এবং বিরোধীদের ফলাফলের ব্যাখ্যাও করেছেন তিনি। তিনি বলেন, এটা বিজেপির জন্য সেমি-ফাইনাল ছিল না। কারণ তারা ইতিমধ্যে ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছে। এটা সেমি-ফাইনাল ছিল বিরোধীদলের জন্য। আসনের দিক থেকে দেখতে গেলে বিজেপি ভাল ফল করেছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। অন্যদিকে এই তিনটে রাজ্যের নিরিখে গত লোকসভা ভোটে যেহেতু বিজেপি গত দু’বারই বেশ ভাল ফল করেছে, তাই সেখানে আর নতুন করে কিছু করার নেই। বিজেপির নিরিখে এই তিন রাজ্যে খুব একটা পরিবর্তন হবে এমনটা নয়। এটা বিজেপি কে উজ্জীবিত করবে। আর তাই এটা বিজেপির কাছে সেমি-ফাইনাল নয়, এটা ছিল প্র্যাকটিস ম্যাচ। এবং তাতে তারা ভাল ফল করেছে। এই তিন রাজ্যে কংগ্রেস এর আগে যা ভোট পেয়েছিল প্রায় তাই-ই পেয়েছে। গত লোকসভায় তারা যা ভোট পেয়েছিল তার তুলনায় ভোট বেড়েছে। সুতরাং আসনের হিসাবে কংগ্রেস পরাস্ত হলেও তাদের সমর্থকদের সংখ্যার যে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে তেমনটা নয়।ঘটনাটা হল, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি যেমন সপা, সিপিআইএম এদের নিজেদের ভোট শতাংশটা আলাদা ভাবে লড়ে এরা ধরে রাখতে পারেনি। এমন হতেই পারে এদের ভোটগুলিই বিজেপিতে চলে এসেছে।
তিনটি রাজ্যের বিপুল জয় আসন্ন লোকসভা ভোটের পরিণামের ইঙ্গিত কিনা সে প্রসঙ্গে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বিবিসি বাংলা কে বলেছেন, নরেন্দ্র মোদী যে ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে বিরোধীরা একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে, বা ২০২৩ এর বিধানসভা ভোটের ফলাফল ২০২৪ এর আসন্ন লোকসভা ভোটের ফল নির্ধারণ করে দিয়েছে, তেমনটাও নয়।
সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর কার্যত ‘কোণঠাসা’ হতে হয়েছে দলটিকে। প্রশ্নের মুখে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বও। নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের পর রাহুল গান্ধী অবশ্য ‘জন আদেশ’ মাথা পেতে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, “মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়ে জনগণের জন আদেশ আমরা মাথা পেতে নিচ্ছি। বিচারধারার লড়াই জারি থাকবে। তেলেঙ্গানার মানুষকে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রজাপ্রিয় তেলেঙ্গানা বানানোর প্রতিশ্রুতি আমরা পালন করব।”
রাহুল গান্ধীর স্বীকারোক্তি অবশ্য তাঁকে শরিকদের তোপের মুখে পড়া থেকে রক্ষা করতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃনমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি ‘ইন্ডিয়া জোটের’ ও শরিক দলগুলির মধ্যে একটি, বলেছিলেন, “এটা মানুষের হার নয়, কংগ্রেসের হার। মানুষ বিজেপির বিরুদ্ধেই ভোট দিতে চেয়েছেন। তিনি ‘ইন্ডিয়া জোটের’ শরিক দলগুলির মধ্যে আসন ভাগাভাগির উপর জোর দিয়ে বলেছিলেন, “আমরা বারবার বলেছি, আসন ভাগ কর, না হলে এটা হয় না।”
কংগ্রেসের ‘ভরাডুবির’ ফলে শরিকদলের অনেকে ‘ক্ষোভ’ উগড়ে দিয়েছে। তারা কংগ্রেসের মনোভাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর সহকারী সভাপতি ওমর আবদুল্লার কথায়, নির্বাচনের সময় কংগ্রেস যা বলেছিল তা ফাঁকা আওয়াজ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এর পাশাপাশি জোটের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগও তোলেন তিনি। এনসিপির প্রধান শরদ পাওয়ার মনে করেন, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও মিজোরামের বিধানসভা নির্বাচনের ফলের প্রভাব বিরোধী জোটের উপর পড়বে না। একই সুর ধরা পড়েছে শরিক দের অন্যান্য নেতাদের মধ্যেও।
ইন্ডিয়া জোটের ভবিষ্যৎ
এই মুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ইন্ডিয়া জোট। তাদের শেষ বৈঠক হয়েছিল অগাস্ট মাসের শেষে মুম্বাইতে। সে সময়ে, একাধিকবার আলোচনার পরেও কংগ্রেস হাইকমান্ড সারা দেশে ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনার বিষয়ে ‘উৎসাহ দেখায়নি’ বলেই শরিক দলগুলোর মধ্যে অনেকে অভিযোগ জানিয়েছিল। সম্প্রতি বিধানসভা ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর তড়িঘড়ি একটি বৈঠকের ডাক দিয়েছিলেন কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। ছয়ই ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারতের শরিক দলগুলিকে নৈশভোজের জন্য ডাকা হয়েছিল বলে কংগ্রেসের তরফে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তৃনমূল-সহ একাধিক শরিক দল অভিযোগ করেছে, ‘তাঁদের অনেকেই এই আমন্ত্রণের কথা জানতেনই না, বা তাঁদের জানানো হয়নি।’ এই পরিস্থিতিতে ‘ইন্ডিয়া জোটের’ বৈঠক বাতিল করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার মল্লিকার্জুন খাড়গের বাসভবনে ওই জোটের শরিকদলগুলির সাংসদীয় নেতাদের নিয়ে একটি বৈঠক হওয়ার কথা। অন্যদিকে, রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন, বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের ব্যর্থতা ‘জোটের’ উপর প্রভাব ফেলবে। একাধিক শরিক দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তোপও দেগেছে। এর মধ্যে মমতা ব্যানার্জিকে ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্বে আনার কথা বলছে তার দল।
মোদীর জয়ের ইঙ্গিত?
ইন্ডিয়া জোটের শরিক দলগুলির মধ্যে ‘কোন্দল’ ২০২৪ এর লোকসভা ভোটে পড়বে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। হিন্দি বলয়ে যেমন মোদীর জনপ্রিয়তা স্পষ্ট, তেমনি দক্ষিণে কংগ্রেস বাজি মাত করেছে। তবে দক্ষিণে কর্ণাটক, কেরালা এবং তামিলনাড়ু মিলিয়ে আসন ১২৯টি, আর উত্তরে ২২৯টি। দক্ষিণের ফলাফল লোকসভা ভোটে কতটা প্রভাব ফেলবে সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে বিরোধী হিসেবে ইন্ডিয়া জোটের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র বলেছেন, “লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীরা বিরোধীদের মতোই লড়াই করতে পারেন, নিজের নিজের জায়গায়। ২০০৪-এ পোস্ট পোল অ্যালায়েন্স যেমনটা হয়েছিল, তারা যদি ভাল ফল করে তাহলে সেটাই হবে। সেভাবে তারা জিতবে। এই মুহূর্তে দক্ষিণ ভারতে বিজেপির ফল হয়ত ততটা ভাল না। আর হিন্দি হার্ট লাইন-এ বিজেপির ভাল ফল হওয়ার সম্ভাবনা।
প্রশ্ন এটাও উঠেছে, তিন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের পরিণামের ইঙ্গিত দেয় কি না। অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী মনে করেন এখনই অনুমান সম্ভব নয়। তাঁর কথায় “ঠিক এভাবেই ছত্তিশগড়, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশে বিপুল জয়ের পর অটল বিহারি বাজপেয়ী ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে এনেছিলেন।
কিন্তু তার পরিণাম ভাল হয়নি। কাজেই, সাম্প্রতিক তিন রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফল দেখে ২০২৪ এর পরিণাম এখনই বলা সম্ভব নয়। মোদী এগিয়ে আছেন এটা বলার কারণ, কংগ্রেসের পক্ষে ইন্ডিয়া জোটকে এখনই নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অবস্থায় নেই। আর ছোট শরিক দলগুলির পক্ষে এখনই বিজেপির বিরুদ্ধে আগ্রাসনের সঙ্গে এগোন সম্ভব নয়। তার একটা বড় কারণ তৃণমূলের মতো দলগুলি ইডি এবং সিবিআই-এর মতো গোয়েন্দা সংস্থাদের সামলাতেই ব্যস্ত”।