জাতীয়

দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যে লোহিত সাগর সংকটের যে প্রভাব পড়ছে

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা কয়েক সপ্তাহ ধরে লোহিত সাগরের সমুদ্রগামী জাহাজে হামলা চালাচ্ছে। এই বিপদ এড়াতে বিশ্বের বড় শিপিং কোম্পানিগুলো আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ঘুরপথে পণ্য পরিবহন শুরু করেছে। এতে এশিয়া থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে পণ্য পরিবহনে দুই সপ্তাহ বেশি সময় লাগছে। তাই শিপিং কোম্পানিগুলো এ জন্য বাড়তি খরচ গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। শিপিং কোম্পানিগুলোর বাড়তি মাশুল আরোপের প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশেও। কারণ, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের বড় অংশই পরিবহন হয় এই পথে। অবশ্য আমদানি পণ্যের এক–দশমাংশ আনা হয় এই পথ ব্যবহার করে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের ৬৩ শতাংশের গন্তব্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের ৮ শতাংশ আসে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেই হিসাবে, লোহিত সাগরের সংকটে বাংলাদেশের প্রায় চার হাজার কোটি মার্কিন ডলারের আমদানি–রপ্তানি পণ্য পরিবহনে বাড়তি মাশুল গুনতে হবে।

বাংলাদেশে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সব কটি শিপিং কোম্পানির ব্যবসা রয়েছে। শিপিং–বিষয়ক তথ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আলফালাইনারের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ শিপিং কোম্পানি হলো এমএসসি, মায়ের্সক, সিএমএ–সিজিএম, কসকো ও হ্যাপাগ লয়েড। এ পাঁচটি কোম্পানি বাংলাদেশের আমদানি–রপ্তানি পণ্যের প্রায় অর্ধেক কনটেইনারে পরিবহন করে।

সুইজারল্যান্ডের মেডিটেরিয়ান শিপিং কোম্পানি বা এমএসসি লোহিত সাগরের সংকটের কারণে ‘কন্টিজেন্সি অ্যাডজাস্টমেন্ট চার্জ (সিএসি)’ নামে মাশুল আরোপের ঘোষণা প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে। একইভাবে ডেনমার্কভিত্তিক শিপিং কোম্পানি মায়ের্সক লাইনও তাদের ওয়েবসাইটে ‘ট্রানজিট ডিসরাপশন সারচার্জ’, হ্যাপাগ–লয়েড ‘ইমার্জেন্সি রেভিনিউ চার্জ’ নামে মাশুল বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। সারচার্জ আরোপের চিন্তাভাবনা করছে অন্যরাও।

বাংলাদেশ কতটা মাশুল গুনবে
বাড়তি মাশুলের কারণে মূলত বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা সরাসরি ভুক্তভোগী হবেন। পণ্য আমদানিতে তাদের বাড়তি ভাড়া দিতে হবে। অবশ্য আমদানি বাণিজ্যের বড় অংশে এই প্রভাব পড়বে না। কারণ, বাংলাদেশের পণ্য আমদানির বড় উৎস এশিয়ার দেশগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চীন, ভারত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া—এই চার দেশ থেকে আমদানি পণ্যের ৫০ শতাংশ এসেছে গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ৮ শতাংশ। অন্যদিকে বাড়তি মাশুলের কারণে বাংলাদেশি পণ্যের ইউরোপ–যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, রপ্তানি পণ্য পরিবহনের ভাড়া পরিশোধ করে বিদেশি ক্রেতারা।

বিদেশি ক্রেতাদের হাতে পণ্য তুলে দেয় ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা। জানতে চাইলে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম বলেন, সারচার্জ আরোপের ঘোষণায় কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া দ্বিগুণের কাছাকাছি বেড়ে যাচ্ছে। লোহিত সাগরের সংকট এ ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তবে বিদেশি ক্রেতারা বাড়তি মাশুল পরিশোধ করলেও দেশীয় রপ্তানিকারকদেরও ভুগতে হতে পারে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকেরাও। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বিদেশি ক্রেতাদের যদি বাড়তি মাশুল দিতে হয়, তার প্রভাব দিন শেষে আমাদের ঘাড়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে তারা কম দামে পণ্য কেনার চেষ্টা করবে। এটার ভুক্তভোগী হবে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প মালিকেরা।

পোশাকশিল্প মালিকেরা বলছেন, এখন নতুন মৌসুমের পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ আসছে। তাই এ মৌসুমের পোশাক রপ্তানিতে ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে কিছুটা সংশয় দেখা দিয়েছে।

বিকল্প পথ কেনো শঙ্কার
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে পণ্য আমদানি–রপ্তানির সবচেয়ে সহজ পথ আরব সাগর ও ভূমধ্যসাগরের সংযোগকারী এডেন উপসাগর–লোহিত সাগর–সুয়েজ খাল। এই পথে ইয়েমেন থেকে জাহাজে হামলা চালাচ্ছেন হুতি বিদ্রোহীরা। জাহাজ, পণ্য ও নাবিকদের জন্য বিপদসঙ্কুল হয়ে ওঠায় এখন ঘুরপথে জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। এ জন্য কয়েক হাজার নটিক্যাল মাইল বাড়তি ঘুরতে হচ্ছে জাহাজগুলোকে। এই বাড়তি দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগবে ১১ দিন। পোড়াতে হবে বিপুল জ্বালানি। তাই লোহিত সাগরের সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলে বৈশ্বিক বাণিজ্যের মতো বাংলাদেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যও হোঁচট খাবে।


সূত্র : প্রথম আলো