দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর জনগণকে ভোট দানে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে নতুন কর্মসূচিতে নির্বাচনের দিনেও হরতালের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। বিএনপির নীতি নির্ধারকরা বলছেন, এই নির্বাচন ঠেকানো বা প্রতিহত করার ঘোষণা তারা দিচ্ছে না তবে নির্বাচনের পর নেতাদের ভাষায় সরকার পতনে কঠোর অসহযোগ আন্দোলন শুরু হবে। সরকার বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে কিছুদিন আগে বিএনপি বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। আটাশে অক্টোবরের পর থেকে টানা হরতাল অবরোধ কর্মসূচী দিয়ে যাচ্ছে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক বিএনপি। যদিও বিএনপির ডাকা ধারাবাহিক অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচির শেষ কয়েকটিতে তেমন কোনো শক্ত অবস্থান বা সরকারকে চাপে ফেলার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশে সংঘর্ষের পর থেকে দলের শীর্ষ নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতাসহ দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাবন্দী রয়েছে। এখনও দলের আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হচ্ছে অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে। কিন্তু বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি পালনে দলের নেতাকর্মী বা সমর্থকদের বড় জমায়েত বা টানা দীর্ঘসময় অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। আবার কর্মসূচির মধ্যে বেশকিছু জায়গায় বাসে অগ্নিসংযোগ হয়েছে। একাধিকবার রেলে অগ্নিসংযোগ হয়েছে। যদিও অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলোর দায় বিএনপি বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। বিএনপির নেতারা যে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করেছে সেখানেও দেখা গেছে ঝটিকা শোডাউনের মতো। নেতারা এক জায়গায় অবস্থান করে তড়িঘড়ি করেই শেষ করেন লিফলেট বিতরণ। বুঝা যায়, নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়া এবং মিডিয়ায় প্রচার এখানে একটি মুখ্য উদ্দেশ্য। কারণ বিএনপি চাইছে এই নির্বাচনে ভোট প্রদানে ভোটারদের নিরুৎসাহিত করতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে এরই মধ্যে নানা পরিকল্পনা ও কৌশল নিয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলছেন, নির্বাচনের পরেও আন্দোলন চলবে। তবে কৌশল কী হবে সেটি প্রকাশ করতে চান না। লড়াই করতে আমরা প্রস্তুত। স্বৈরাচার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য তারা চেষ্টা করবে কিন্তু আমরাও জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করবো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। তাই নির্বাচনের পরেও সংগ্রাম আছে আন্দোলন আছে। এ সরকার টিকবে না।
বিএনপি নেতারা বরাবরই সরকারের পতন হবে বা ভোট করতে পারবে না এমন কথা বলে এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ২০১৪ সালে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন করেও সরকার মেয়াদ পূর্ণ করেছে। ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ থাকার পরেও সংসদে গেছে বিএনপি। এ দফায় বিএনপির ভোট বর্জনটি আবারো আওয়ামী লীগের জন্য টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় যাবার পথ বাধাহীন করে দিয়েছে। আর সম্প্রতি আন্দোলনের কর্মসূচিতে সহিংসতার অভিযোগ এনে সরকার আরো কঠোর হয়েছে যেটি বিএনপির আন্দোলনের পথকে আরো চ্যালেঞ্জিং করেছে।
এ পরিস্থিতিতে দলটির চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা ফজলুর রহমান বলছেন, নির্বাচনের পর পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। ২০১৪ সন, ২০১৮ সন ও চব্বিশ সন কিন্তু এক না। এখন কিন্তু রাজপথ উত্তপ্ত, জনগণ উত্তপ্ত। জনগণ যদিও রাজপথে ওইভাবে অংশগ্রহণ করতেছে না কিন্তু রাজপথে যে তিনটা ছেলে স্লোগান দেয় হাসিনার নির্বাচন মানি না এই তিনটা ছেলেই তিনকোটি মানুষের মুখপাত্র এবং কণ্ঠ। লক্ষ লক্ষ মানুষের নামে মামলা। কোটি কোটি মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে বেড়ায়। এটাতো মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বাংলাদেশে খারাপ একটা অবস্থায় হাসিনা সরকার এ দেশটাকে নিয়ে গেছে । এর মধ্যে দাড়িয়ে যে স্লোগানটা দিতে পারতেছি যে এই ইলেকশন মানি না, এটাইতো বড় বিজয়। নির্বাচনের পর কী ধরনের কর্মসূচি আসতে পারে, সাত তারিখে ওবায়দুল কাদের বলছে ফাইনাল খেলা হবে, না- সাত তারিখে ফাইনাল খেলা শুরু হবে। অসহযোগ আন্দোলনের চেয়ে বড় কোনো আন্দোলন নাই। অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকবে। সেই অসহযোগটা বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে আসবে। কোনো ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাতে না পারে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা আসতে পারে প্রতিরোধ আসতে পারে। আসবেই।
বিএনপি যখন অসহযোগের ডাক দিয়ে সারাদেশে ভোট বর্জনের কর্মসূচি পালন করছে তখনো দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় রয়েছে তালাবদ্ধ। আর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেও জনগণের মধ্যে তেমন সাড়া কিংবা এর খুব একটা কার্যকারিতা সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি।
নির্বাচনকে সামনে রেখে এ পর্যায়ে বিএনপি ভোটারদের নিরুৎসাহিত করার বিষয়টিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। নির্বাচন প্রতিহত করা বা ঠেকানোর কোনো আন্দোলন বিএনপি করবে না বলেও স্পষ্ট করেছেন দলটির সিনিয়র নেতা ও স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। তিনি বলেন, আমরা জনগণের রাজনীতি করি জনগণের সঙ্গে আছি জনগণের সঙ্গে থাকবো। এবং জনগণকে নিয়েই আমরা রাজনীতি করে যাবো। বিএনপি অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য্যের জন্য রাজনীতি করে না, বিএনপি ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে না এ কথাটা আমি স্পষ্ট করে বলছি। আন্দোলন আগামীতে এভাবেই চলবে যে আমরা জনগণকে সাথে নিয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করে রাজপথে আমরা যেটা গণতন্ত্রের কথা সেকথা বলে যাবো যতক্ষণ না পর্যন্ত এদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
এদিকে টানা ১৭ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বর্তমানে রাজনীতিতে একটা জটিল ও কঠিন সময় পার করছে বলেই বিবেচনা করা হচ্ছে। ২৮ অক্টোবর সংঘাত পরবর্তী পরিস্থিতিতে মামলা ও গণগ্রেপ্তারের কারণে রাজনীতির মাঠে দল আরো কোনঠাসা হয়েছে বলেই অনেকে মনে করেন।এছাড়া জাতীয় নির্বাচন বর্জন এবং আন্দোলনের কর্মসূচী বিষয়ে মতভেদ থেকে সিনিয়র নেতাদের দলত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। দল থেকে বেরিয়ে কয়েকজন সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এ বাস্তবতায় বিএনপির ভবিষ্যত আন্দোলন কৌশল যেমনই হোক দলটির সংগ্রাম যে আরো দীর্ঘ হতে যাচ্ছে এমন ধারণাই তৈরি হচ্ছে। বিএনপিপন্থী শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মামুন আহমেদ মনে করেন বিএনপির আন্দোলন সংগ্রাম দীর্ঘ হবে।