আন্তর্জাতিক

ভারতে তিন রাজ্যের ভোটে বিপুল জয় বিজেপির, কংগ্রেসের জয় এক রাজ্যে


Deprecated: Function get_the_author_ID is deprecated since version 2.8.0! Use get_the_author_meta('ID') instead. in /home/bkotha24/public_html/wp-includes/functions.php on line 6114

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ১:১০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৪, ২০২৩

রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় আর তেলেঙ্গানার ভোট গণনা রবিবার সকাল থেকে শুরু হয়। দুপুরের মধ্যেই ফলাফলের যা ট্রেন্ড ছিল, তাতে বোঝাই যাচ্ছিল যে ছত্তিশগড় আর রাজস্থানে ক্ষমতাচ্যুত হতে চলেছে কংগ্রেস। আর মধ্যপ্রদেশেও বিজেপিকে পরাজিত করে তাদের ক্ষমতায় ফেরা যে সম্ভব নয়, সেটাও বোঝা গিয়েছিল। দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানায় দীর্ঘদিন ধরে সেখানে ক্ষমতায় থাকা আঞ্চলিক দল ভারত রাষ্ট্র সমিতির থেকে অনেক বেশি আসন নিয়ে সেখানে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস।

রাজ্যভিত্তিক ফলাফল
সন্ধ্যা থেকে নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত ফলাফল দিতে থাকে। ভারতীয় সময় রাত আটটায় যে ফলাফল ভারতের নির্বাচন কমিশন দিয়েছে, তাতে মধ্যপ্রদেশে ২৩০ আসনের বিধানসভায় ১২৭টিতে জিতে গেছে বিজেপি, আরও ৩৭টিতে তারা এগিয়ে আছে। অন্যদিকে, কংগ্রেস জিতেছে ৩৮টিতে, এগিয়ে রয়েছে ২৭টি আসনে। ছত্তিশগড়ে ভোট গণনা শুরু হওয়ার বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে কংগ্রেসই এগিয়ে ছিল। কিন্তু দুপুরের দিকে বিজেপি তাদের পিছনে ফেলে এগোতে শুরু করে। বিজেপি সে রাজ্যে জিতেছে ৩৩ টি আসনে, এগিয়ে আছে আরও ২১টিতে। কংগ্রেস জিতেছে ২০টি আসন, এগিয়ে আছে ১৫টিতে। রাজস্থানে বিজেপি আর কংগ্রেসের ফারাক সবথেকে বেশি। সেখানে ১১৪ টি আসনে জিতেছে বিজেপি, একটি আসনে তারা এগিয়ে আছে। গত পাঁচ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস জিতেছে ৬৪টি আসনে, এগিয়ে আছে একটিতে। রাজস্থান আর ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসের সরকার ছিল। মধ্যপ্রদেশে গত নির্বাচনে কংগ্রেস জিতেছিল, কিন্তু বছর দেড়েকের মধ্যে একসঙ্গে অনেক দলীয় বিধায়ক দল বদল করে বিজেপিতে চলে যাওয়া কংগ্রেস সরকার পড়ে যায়, ক্ষমতায় আসে বিজেপি।

উত্তর আর মধ্য ভারতে কংগ্রেস পরাজিত হলেও সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য তেলেঙ্গানায় তারা ৫৯টিতে জিতেছে, আর এগিয়ে আছে পাঁচটিতে। রাজ্যটির জন্মলগ্ন থেকেই যে দল সেখানে ক্ষমতায় আছে, সেই ভারত রাষ্ট্র সমিতি জিতেছে ৩৩টিতে, এগিয়ে আছে ছয়টি আসনে। এই রাজ্যে বিজেপিও নেমেছিল ভোটের আসরে। তারা এগিয়ে আছে সাতটি আসনে জিতেছে, একটিতে এগিয়ে আছে। এই চার রাজ্যের সঙ্গেই উত্তরপূর্বের রাজ্য মিজোরামেও ভোট নেওয়া হয়েছিল। সেখানেও রবিবারই ভোট গণনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খ্রিস্টান প্রধান ওই রাজ্য থেকে দাবী উঠেছিল যে রবিবার যেহেতু সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই গির্জায় প্রার্থনা করতে যান, তাই গণনার দিন পিছিয়ে দেওয়া হোক। নির্বাচন কমিশন সূচি বদল করে সোমবার ভোট গণনার দিন স্থির করেছে।

বিজেপির জয় নিয়ে নরেন্দ্র মোদী
তিন রাজ্যে বিপুল ভোটে যে জিততে চলেছে দল, সেটা দুপুরেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ওই রাজ্যগুলিতে তো বটেই, দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরেও উচ্ছ্বাস শুরু হয়ে যায়, অনেকটা দিওয়ালির মতো। সন্ধ্যায় সেখানে পৌঁছন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তিনিই ছিলেন এই রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে বিজেপির হয়ে প্রধান প্রচারক। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতর থেকে কর্মী ও ভোটারদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তার ভাষণে তিনি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের বিরুদ্ধে জাতিগত ভিত্তিতে দেশকে বিভক্ত করার চেষ্টা করার অভিযোগ করেন।

প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন, এই নির্বাচনে দেশকে জাতিতে বিভক্ত করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু আমি ক্রমাগত বলছিলাম যে আমার কাছে চারটি জাতি দেশের বৃহত্তম জাতি। আমি যখন এই চারটি জাতির কথা বলি, তখন এটাই বোঝাই যে আমাদের নারী, যুবক, কৃষক এবং দরিদ্র পরিবারগুলিকে ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই দেশের ক্ষমতায়ন হবে। নির্বাচনের ফলাফল আরও একটি বিষয় পরিষ্কার করেছে যে, দেশের যুবসমাজ শুধু উন্নয়ন চায়। রাজস্থান, ছত্তিশগড় বা তেলেঙ্গানা যেখানেই হোক না কেন, যেখানেই সরকার যুবকদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, সেই সরকারগুলিকে ভোট দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে, এই তিন রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা দলগুলি এখন ক্ষমতার বাইরে। তেলেঙ্গানা, যেখানে তার দল তৃতীয় স্থানে রয়েছে, সেই প্রসঙ্গে মোদী উল্লেখ করেন যে দলটি দক্ষিণের এই রাজ্যে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। গত নির্বাচনের তুলনায় তেলেঙ্গানায় বিজেপি তাদের ভোট ভাগ প্রায় দ্বিগুণ করেছে।

রাহুল গান্ধীর টুইট
হিন্দি বলয়ের দুই অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ছত্তিশগড় এবং রাজস্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া এবং মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় ফিরতে না পারা কংগ্রেসের কাছে একটা বড় ধাক্কা। দলের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধী বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে সঙ্গে নিয়ে সব রাজ্যেই প্রচারে গিয়েছিলেন। যদিও সব রাজ্যেই কংগ্রেসের স্থানীয় নেতারাই মূল প্রচার চালিয়েছেন, বিজেপির মতো কেন্দ্রীয় নেতাদের চেহারা তারা সামনে আনেন নি। ভোটের ফলাফল বেরনোর পরে রাহুল গান্ধী টুইট করেছেন, ‘নম্রভাবে’ তারা জনগণের রায় গ্রহণ করেছেন “আদর্শের লড়াই অব্যাহত থাকবে,” বলে তিনি এক্স-এ পোস্ট করেছেন। প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি তেলেঙ্গানার ভোটারদেরও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি এও লিখেছেন, আমরা অবশ্যই ‘প্রজালু (সাধারণ মানুষের) তেলেঙ্গানা’ তৈরির প্রতিশ্রুতি পূরণ করব।

হিন্দুত্ব ছিল সব দলেরই এজেন্ডা
রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় আর তেলেঙ্গানা – এই চার রাজ্যেই হিন্দুত্ব একটা প্রধান এজেন্ডা ছিল। যে হিন্দুত্ব এতদিন বিজেপির একচেটিয়া দখলে ছিল, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস এবং তেলেঙ্গানায় ভারত রাষ্ট্র সমিতি – সব কটি রাজ্যেই হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রচার প্রসার ঘটেছে সরকারি অর্থানুকূল্যে। এই হিন্দুত্বের প্রচার, হিন্দু তীর্থক্ষেত্রগুলির সংস্কারে রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর তেলেঙ্গানায় কোটি কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকেই ব্যয় করা হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে। আর মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসও সেখানে তাদের নেতা কমল নাথের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই হিন্দুত্বের প্রচার করে গেছেন গত সাড়ে তিন বছর ধরে।

বিবিসির মধ্যভারত সংবাদদাতা সলমান রভি সম্প্রতি বলছিলেন, “ছত্তিশগড় আর মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস বিজেপির কাছ থেকে হিন্দুত্বের এজেন্ডা কেড়ে নিয়েছে বলা চলে। ছত্তিশগড়ে মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল ‘রাম বন গমন পথ’, অর্থাৎ যে পথে রামচন্দ্র বনবাসে গিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়, তার ব্যাপক সংস্কার করিয়েছেন ১৬২ কোটি টাকা ব্যয় করে।” “আবার রামচন্দ্রের মা, কৌশল্যার একমাত্র যে মন্দির আছে ভারতে, সেটাও ছত্তিশগড়েই। তার সংস্কার করেছেন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী। সেটার উদ্বোধন করতে মুখ্যমন্ত্রী নিয়ে এসেছিলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভগবতকে। অন্যদিকে মধ্যপ্রদেশের প্রধান কংগ্রেস নেতা কমল নাথ, যিনি দেড় বছরের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনিও ব্যাপকভাবে হিন্দুত্বের প্রচার করছেন।

মি. কমল নাথ তার নিজের ভোটকেন্দ্র ছিন্দওয়াড়াতে মধ্যভারতের সবথেকে বড় হনুমান মূর্তি স্থাপন করেছেন সম্পূর্ণ নিজের অর্থ দিয়ে। রাজধানী ভোপালের কংগ্রেস দপ্তরে রামনবমী উদযাপিত হয়। আবার কপালে টিকা দিয়ে হিন্দুত্ববাদী নেতাদের মতই তিনি ভোটের প্রচার করেছেন। রাজস্থানে পুষ্কর-বৈষ্ণোদেবী মন্দিরের সংস্কার করছে সেখানকার কংগ্রেস সরকার, তারা ২৬টা বৈদিক স্কুল চালায় সরকারি টাকা দিয়ে। ওই বিদ্যালয়গুলি সবই কোনও না কোনও মন্দির পরিসরে গড়া হয়েছে। তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও-ও হিন্দু দেবদেবীদের মন্দির সংস্কারের জন্য বহু কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে বরাদ্দ করেছেন।

উত্তর, মধ্য ভারতে হিন্দুত্বের জয়, দক্ষিণে হার
এবারের নির্বাচনে যেহেতু সব রাজ্যেই হিন্দুত্ব একটা এজেন্ডা থেকেছে সব দলের কাছেই, তাই এই ফলাফলও হিন্দুত্বের রাজনীতির জয় পরাজয় ঠিক করেছে। যদিও উত্তর ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের ফলাফল সম্পূর্ণ বিপরীত হয়েছে। নির্বাচন বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী ব্যাখ্যা করছিলেন, উত্তর ভারতের তিনটি রাজ্যে বিজেপির রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং প্রধানমন্ত্রীর জনসম্মোহিনী ক্ষমতা, সেটাকে কাজে লাগিয়েই তারা এখানে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছে। উল্টোদিকে তেলেঙ্গানায় ভারত রাষ্ট্র সমিতি যেভাবে রাজ্য চালাচ্ছিলেন, সেটা যে মানুষ মেনে নেয় নি, তারা বিকল্প বেছে নিয়েছে। এখানে বিজেপিও ব্যর্থ হয়েছে। তেলেঙ্গানার ফল থেকে আরও একটা বিষয় উঠে আসছে, দক্ষিণ ভারতে বিজেপি কিন্তু কোথাও দাঁত ফোটাতে পারল না। এর আগে কর্ণাটকে তারা পরাজিত হয়েছে, এবার তেলেঙ্গানাতেও পারল না। হিন্দি বলয় এবং অ-হিন্দিভাষী দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে একটা স্পষ্ট মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে।

লোকসভা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে?
এই বিধানসভা নির্বাচনগুলিকে বলা হচ্ছে আগামী বছরের লোকসভা ভোটের আগে ‘সেমিফাইনাল’। তাই এই ভোটের ফলাফল পরের বছরের নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সবসময়েই লোকসভা ভোটের মাস ছয়েক আগে এই রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচন হয়ে থাকে। তবে এই রাজ্যগুলির ভোটের ফলাফল যে সবসময় পরের বছরের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের ইঙ্গিত দেয়, তা নয়। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তিশগড়ে ২০১৮ সালে কংগ্রেস জিতেছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদীই বিপুল ভোট পেয়ে ফিরে এসেছিলেন।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী বলছিলেন, সম্প্রতি দেখা গেছে যে বিধানসভা নির্বাচনে মানুষ রাজ্যভিত্তিক ইস্যুগুলিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের সময়ে তারা জাতীয়-স্তরের কোনও দলের প্রতিই তাদের সমর্থন প্রকাশ করতে চান। এবারে বিজেপির বিপ্রতীপে যে ইন্ডিয়া জোট তৈরি হয়েছে, তারা একটা স্বপ্ন দেখাতে বা সম্ভাবনা দেখাতে শুরু করলেও রবিবারের ফলাফলে এটা প্রমাণিত যে তারা বিশেষ কোনও প্রভাব ফেলতে পারে নি। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অবস্থাটা পাল্টিয়ে ফেলতে পারবে, এমনটাও নয়।