বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীরা সম্প্রতি এমন চমকপ্রদ কিছু বিষয় আবিষ্কার করেছেন যা হয়তো ব্যাখ্যা দিতে পারবে, মানুষ কেন মনে করে যে সে ভূত দেখেছে। রাতে অশরীরি কোনো কন্ঠস্বর, অদ্ভুত দর্শন কিছু, মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাওয়া। অনেক মানুষই হয়তো তাদের জীবনে এমন ভুতুড়ে কিছু অনুভব করেছেন যার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। যেমন ধরুন, পেনিফোর্ড ফার্মের খামারবাড়ির বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা। উত্তর ওয়েলসের ফ্লিন্টশায়ারে বাড়ির প্রাক্তন মালিকরা দাবি করেছিলেন, ১৯৯০ এর দশকে তারা যখন এখানে থাকতেন, তখন সেখানে ভূতের উপদ্রব ছিল।
গণমাধ্যমে দেয়া বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে তারা বলেন, ওয়েলসের দেয়ালজুড়ে অদ্ভূত ভাষার কথা শুনতে পান তারা, যে ভাষায় তারা কেউ কথা বলেন না, এরপর বাড়ির জিনিসপত্র একা একা বিভিন্ন দিকে নড়তে শুরু করে এবং তারা আসলে একজন গর্ভবতী তরুণীর দ্বারা ভুতুড়ে কর্মকান্ডের শিকার হয়েছেন যাকে বাগানে সমাহিত করা হয়েছিল।
বিবিসি প্যারানরমাল অনুষ্ঠানের জন্য এসবের সত্যতা জানতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং সেখানকার সেইসময়ের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে।বিবিসি থ্রি এবং বিবিসি ওয়েলস এই খামারবাড়িতে গিয়ে ভেতরের কিছু জিনিস দেখিয়েছে যা এতদিন পর্যন্ত তালাবদ্ধ ছিল। সিরিজটিতে বিবিসি রেডিও ওয়ানের ডিজে সিয়ান এলেরি এই বাড়িতে কী ঘটেছে তার একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেন। তবে এ কাজে তিনিই প্রথম নন, অনেকদিন ধরে বহু মানুষ ভূত দেখার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে চলেছেন।
বিবিসি থ্রি এমন দুজন বিজ্ঞানীর সাথে কথা বলেছে যারা এরইমধ্যে সেটি করতে সমর্থ হয়েছেন। প্যারানরমাল ঘটনার প্রমাণ বিজ্ঞানে না থাকলেও মানুষ বিশ্বাস করে যে সে ভূত দেখেছে, আর এর পেছনে মানসিক ও পরিবেশগত কিছু দিক তুলে এনেছেন এই দুই বিজ্ঞানী। ড. ক্রিস ফ্রেঞ্চ লন্ডনের গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানোম্যালিস্টিক সাইকোলজি রিসার্চ ইউনিটের প্রধান বলেন, একটা কালো বিড়াল তার মুখ থেকে ভয়ংকর কালো পদার্থ বের করছে আর হিসহিস করছে। এই ইউনিটের কাজ হল মানুষের যেসব প্যারানরমাল বিশ্বাস ও ব্যাখ্যাতীত অভিজ্ঞতা হয়, সেগুলোর পেছনের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করা। তিনি অনেক ভূত দেখার গল্পের পেছনের কারণ হিসেবে স্লিপ প্যারালাইসিসকে তুলে এনেছেন, যেটাকে বাংলায় কেউ কেউ ‘বোবায় ধরা’ বলে থাকেন। মানুষ যখন তার ঘুমের একটা বিশেষ পর্যায় র্যাপিড আই মুভমেন্ট (আরইএম) – এ পৌঁছায়, তখন আর মস্তিষ্ক শরীরকে নড়াচড়ার সংকেত পাঠায় না। আর ঠিক এই সময়টায় মানুষ কখনো জেগে উঠলেও নড়াচড়া করতে পারে না।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বা এনএইচএস ওয়েবসাইট বলছে, স্লিপ প্যারালাইসিসের অন্যান্য কিছু স্বাভাবিক লক্ষণ হল, মনে হবে কেউ আপনার ঘরে আছে অথবা আপনাকে চেপে ধরে আছে। আর যেহেতু র্যাপিড আই মুভমেন্টের সময়টায় মানুষ সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখে তাই এসময় হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টিবিভ্রম হতে পারে।
ড. ক্রিস ব্যাখ্যা করেন, স্লিপ প্যারালাইসিস হল স্বাভাবিক ঘুমের প্রক্রিয়ায় এক ধরনের ত্রুটি, এটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। আমার একজন ছাত্র আমাকে ঘুম থেকে উঠার বিষয়ে বলেছিল যে তার বিছানার পাশে একটি কালো বিড়াল তার দিকে তাকিয়ে হিস হিস করছে। কিন্তু এটা একটা উল্টানো বিড়ালের মাথার খুলি ছিল যার মুখ থেকে কালো পদার্থ ঝরছিল,” বলেন ড. ক্রিস।
স্লিপ প্যারালাইসিসের ক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশনের বিষয়টি ‘শতকরা খুব সামান্য’ পরিমাণে উঠে আসে। কিন্তু যেহেতু স্লিপ প্যারালাইসিস অনেকের মাঝেই দেখা যায় তাই সেই ‘শতকরা খুব সামান্য’ হ্যালুসিনেশন অনেক মানুষকে ভূত দেখায়, মি. ক্রিস ব্যাখ্যা করেন।
‘ভুতুড়ে’ বাড়িতে অনেক বেশি ফাঙ্গাস থাকে
ডা. শেন রজার্স নিউইয়র্কের ক্লার্কসন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ও এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একজন অধ্যাপক। তিনি ভুতুড়ে বাড়ি এবং ফাঙ্গাসের মধ্যে সংযোগের বিষয়টি নিয়ে বিশদ কাজ করেছেন। শেন লক্ষ্য করেন, তার বাচ্চাদের বেজমেন্টে নিয়ে দেয়ালে ফাঙ্গাস দেখানোর পর তারা ‘অদ্ভুত আচরণ’ করে। তিনি ভুতুড়ে বাড়ি নিয়ে একটা টিভি সিরিজেও লক্ষ্য করেন যে সেখানে প্রচুর ফাঙ্গাসের চিহ্ন আছে। এরকম ফাঙ্গাস দেখার পর মানুষের যে অভিজ্ঞতা হয় সেটা তারা যে ভূত দেখার কথা বলে, তার সাথে মিলে যায়।
এনএইচএস বলছে, সাধারণত স্যাঁতসেঁতে বিল্ডিংয়ে যে ফাঙ্গাস দেখা যায় সেগুলো শ্বাসকষ্ট এবং চোখের জ্বালাপোড়ার কারণ হতে পারে, যা থেকে মানুষ কখনো কখনো কালো অবয়ব দেখতে পায়। ল্যাব টেস্টেও একটা ইঁদুরকে কালো ফাঙ্গাস দিয়ে দেখা হয়েছে যে সেটা তার ভেতর কোনো ভয়ের অনুভূতি তৈরী করে কিনা। শেন এবং তার দল ২৭টি জায়গা থেকে বিভিন্ন সব ফাঙ্গাস সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়, যার মধ্যে ১৩টিই ভুতুড়ে জায়গা হিসেবে পরিচিত। এই দলটা ফাঙ্গাস এবং ভূতের উপদ্রবের খবরের মধ্যে একটা শক্ত সংযোগ খুঁজে পান।
ডা. শেন বলেন, আমরা আমাদের নমুনা থেকে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি যে, পরিসংখ্যানগতভাবে ভুতুড়ে জায়গাগুলিতে ফাঙ্গাসের অস্তিত্ব একটা বড় পার্থক্য গড়ে দেয়। অবশ্য একই সাথে এটাও ঠিক যে আমরা অনেক জায়গায় ফাঙ্গাসের অস্তিত্ব পেয়েছি যেগুলোর সাথে ভূতের উপদ্রবের কোনো সংযোগ নেই। এমনকি আমার বাড়ির বেজমেন্টেও সমস্যা আছে। কিন্তু এই ফাঙ্গাসের ব্যাপারটা ভুতুড়ে আর স্বাভাবিক বাড়ির মধ্যে একটা বড় পার্থক্য সৃষ্টি করে। আপনাকে কেউ যদি বলে এই ঘরে ভূত আছে, তাহলে সেখানে প্রতিটা শব্দ আপনার নজর কাড়বে। যেসব মানুষ মনে করে তারা ভূত দেখেছে তাদের এই চিন্তার পেছনে তিনটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকে: পূর্ব বিশ্বাস (আপনি যদি আগে ভূতে বিশ্বাস করেন তাহলে আপনি কোনো অদ্ভুত অভিজ্ঞতাকে প্যারানরমাল বলে মনে করবেন), পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং হ্যালুসিনেশন। যখন মানুষ ভূত শব্দটা শোনে, তখন কল্পনা করে যে দেয়ালে শেকলবাঁধা ভূত হাঁটছে। মানুষ এরকম বলে, কিন্তু এটা খুবই বিরল। এটা অনেক বেশি অস্পষ্ট একটা অনুভূতি। কারো অস্তিত্ব টের পাওয়া, মাথা ঘোরা, ঝাপসা দেখা, শরীরে তাপমাত্রার পরিবর্তন হওয়া বা মেরদন্ডে কাঁপুনি। হ্যালুসিনেশন তো খুবই স্বাভাবিক। যে কারো দীর্ঘসময় ঠিকমতো ঘুম না হলে, অত্যাধিক মানসিক চাপ বা উচ্চ তাপমাত্রায় এটা হতে পারে। পারিপার্শ্বিক অবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ। “যদি আপনাকে কেউ খুব পুরনো একটি ভবন দেখিয়ে বলে এখানে ভূতের অস্তিত্ব আছে, তাহলে আপনি এখানকার প্রতিটি শব্দ লক্ষ্য করবেন এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন খেয়াল করবেন, যেটা হয়ত ভূতের কথা না বললে করতেন না।
একটি কৃত্রিম ভুতুড়ে কক্ষ
ভূতের অস্তিত্ব নিয়ে আরো দু’টি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। একটা হল, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড মানুষের মস্তিষ্কে সংকেত পাঠিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ফলে হ্যালুসিনেশন হয়। আরেকটা হল শব্দ, যা এতটাই আস্তে যে একজন মানুষের শোনার জন্য যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে মতবাদটি হল, কিছু নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি (১৯ হার্টজের কাছাকাছি) মানুষের চোখের মণিতে একটা কম্পন সৃষ্টি করে, যা থেকে দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে। এই দুটো মতবাদ যাচাই করতে ক্রিস ও তার দল একটা কৃত্রিম ভৌতিক কক্ষ বানিয়েছেন। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের ইনফ্রাসাউন্ড ও ইলেকট্রোম্যাগনেটিক কার্যক্রম দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। ক্রিস জানান, মানুষ এই কক্ষে অস্বাভাবিক অনুভূতির কথা বলছে। ৮ শতাংশ মানুষ তো ভয় পাওয়ার কথাও জানিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল আমরা যখন ফলাফল বিশ্লেষণ করছি, তখন আসলে ইনফ্রাসাউন্ড বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিকের ব্যাপারটা আর গুরুত্বপূর্ণ থাকছে না। আপনি যদি কয়েকজনকে বলেন যে এই কক্ষে আপনার কিছু অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা হতে পারে, সেটাই আসলে একধরণের পরামর্শের মতো কাজ করছে। অর্থাৎ এটা এই পরামর্শের ক্ষমতা ছাড়া আর কিছু নয়।